ব্যবসাবাণিজ্যের বেহাল দশা ও করণীয়
প্রথম নিউজ, অনলাইন : গত জুলাই মাস থেকে দেশে শুরু হয় লাগাতার আন্দোলন! আগস্টে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে বর্তমান সরকারের ছয় মাস। এই ছয় মাসে দেশে কোনো লক্ষণীয় ইতিবাচক পরিবর্তন দেখছি না আমরা। যেন আগের চেয়েও ঢিমে হয়ে গেছে। যে কোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের পর দেশে কিছু বিশৃঙ্খলা হয়, নানান ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়, একটা সুবিধাবাদী শ্রেণির জন্ম নেয়, নতুন সরকারের কাছের লোক প্রমাণ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে কিছু লোক। সেসব তো আছেই। বরং বেড়েছে আরও কিছু উপদ্রব, অনেক সমস্যা। আগের সরকারে দ্রব্যমূল্যের ভারে জনজীবন ছিল বিপর্যস্ত।
নাভিশ্বাস উঠছিল সাধারণ মানুষের। এখন সেটা না কমে বরং বেড়েছে। এর কারণ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিকে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।ভাঙেনি সিন্ডিকেট। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সিন্ডিকেট আগের চেয়েও আড়ম্বরে জাঁকিয়ে বসেছে। যে প্রান্তিক কৃষক সবজি বিক্রি করেন বিশ টাকায় সেটা ঢাকা বা অন্য বড় শহরে যেতে যেতে হয়ে যায় এক শ টাকা। না দাম পায় কৃষক না কিনে খেতে পারে দরিদ্র নিম্ন-মধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত। পুরোটাই মুফতে পকেটে পুরে মধ্যস্বত্বভোগীরা।
ছয় মাসে কেন এই সিন্ডিকেট ভাঙা গেল না, কেন বাজার নিয়ন্ত্রণ করা গেল না, কেন চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেল না জানি না আমরা। গ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পণ্য আনতে দফায় দফায় বারবার চাঁদা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। আর তার পুরোটাই এসে পড়ে সাধারণ জনগণের ঘাড়ে।
অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বিশেষ করে নিত্যপণ্যের মূল্য অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া। সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষ জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। জুলাইয়ের আন্দোলনে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। এর আগে বছরাধিককাল ধরে কভিডের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। জুলাইয়ে তিন সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন। এ আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ, সাধারণ ছুটি ঘোষণাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছিল। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। পাড়া-মহল্লার দোকান, রেস্তোরাঁ, ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের অনেকে দোকানপাট খুলতেই পারেনি। রাস্তায় ফেরি করে যারা বিক্রি করেন তারা বের হতে পারেননি। ফুটপাতে বসে যারা দোকান করেন ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে গেছেন। এরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন একেবারে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এখন ব্যবসাবাণিজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকদের মতে, এ চ্যালেঞ্জ দুই রকম। এক, সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য সচল করা। দুই, অর্থনীতিতে বিরাজমান সংকটসমূহের সমাধান করা। অর্থনীতির অবস্থা একদিনে এমন হয়নি। বহুদিন ধরে অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নগামী। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ধীরগতি, ঋণের দায়দেনা, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়া, এমন অনেক সূচক অর্থনীতিকে বিপদগ্রস্ত করেছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না, বিনিয়োগেও ঘাটতি রয়েছে। বড় ব্যবসায়ী আর ছোট ব্যবসায়ীদের সমস্যা ভিন্ন। বড়রা ভুগছেন মুদ্রা বাজার, আমদানি, রপ্তানি জটিলতায়। এলসি টেরিফ নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা। অন্যদিকে ছোটরা ভুগছেন লাইসেন্স, গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ না পাওয়ার মতো সমস্যায়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির একটি গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রশাসনের অসহযোগিতা ও অদক্ষতায় মারাত্মক ভোগেন। প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন ও জবাবদিহিতা নেই। মাসের পর মাস ফাইল পড়ে থাকে। কর্মকর্তারা হয় কাজ জানেন না, অথবা কাজ করতে চান না কিংবা যা চান তা দেওয়া হয় না বলে কাজ করেন না। জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই বলে প্রতিকার চাওয়ার জায়গা থাকে না। প্রতিকার চাওয়ার সাহসও করেন না ভুক্তভোগীরা। কারণ কাজের জন্য ওদের কাছেই যেতে হয় আবার। তা ছাড়া ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক খাত বরাবরই অনুদার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে ২৫ লাখের বেশি খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ী আছেন। তাদের অধিকাংশই লোকসানে পড়েছেন। তাদের হিসাবে, গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল অর্থবছরে সর্বোচ্চ। সদ্যবিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছর ওয়ারি হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) প্রায় এক হাজার কোটি ডলারের মতো কমেছে। সর্বশেষ জুলাই মাস শেষে আইএমএফের গণনাপদ্ধতি অনুসারে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার। এক বছর আগেও তিন হাজার কোটি ডলারের বেশি রিজার্ভ ছিল।
আমাদের আয়ের প্রধান উৎস বিদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। এই দুই খাতে বড় কোনো অগ্রগতি নেই। ডলারের দাম বাড়তি। উচ্চমূল্যে ডলার কিনে আমদানি ও অন্যান্য বৈদেশিক দায় মেটাতে হচ্ছে। ফলে রিজার্ভের মজুত থেকে বেশি ডলার খরচ হচ্ছে। অর্থনীতির আকার দিনদিন বেড়েছে, রাজস্ব আদায় সেভাবে বাড়েনি। ঢাকার বাইরে অন্য শহরগুলোতে করজাল সেভাবে বিস্তৃত করা যায়নি। বিদায়ি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক অস্থিরতার কারণে শুল্ক কর আদায় তেমন একটা হয়নি। এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করেন, শুল্ক-কর আদায় গত বছরের জুলাই মাসের তুলনায় অর্ধেকে নামবে।
গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংক খাতে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। সেটা এখন শোচনীয় পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংক খাতে এখন ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার মতো খেলাপি ঋণ আছে। ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা পাচার ও রিজার্ভ চুরির মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদানে নানারকম অনিয়ম রয়েছে। স্বজনপ্রীতি, ভুয়া কাগজে ঋণ প্রদান করা হয়েছে বছরের পর বছর। শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে না শোধ করার মতো ঘটনা আছে অনেক। এসব সমস্যার সমাধান জরুরি। ব্যাংক খাতে পেশাদারি মনোভাব ও তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার।
পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, সিটি গ্রুপ, বিএসআরএম, ইউএস-বাংলাসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গ্রুপের দেড় শতাধিক কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বরে ৮৩টি কোম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ১৬০টি কোম্পানির বন্ধের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে। বন্ধের তালিকায় ছোট প্রতিষ্ঠান শুধু নয়, বড় গ্রুপের প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে পণ্য সরবরাহ ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নতুন নিবন্ধন নেওয়া কোম্পানিও রয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি না হলে আরও কোম্পানি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিনিয়োগ আকর্ষণে উদ্যোগ না থাকায় নতুন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সমস্যা সমাধানে সরকারের সহযোগিতা চান ব্যবসায়ীরা।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বন্যার প্রভাবে শিল্প, পর্যটন, কৃষি ও সেবা খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চলছে শ্রমিক অসন্তোষ। এই অসন্তোষের কারণে তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা চলছে। এ খাত আমাদের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আরও বিপাকে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। এভাবে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত।
বন্ধ হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিও। দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক কোম্পানি ব্রাইড মেডিকেল অ্যান্ড এডুকেশন সার্ভিস লিমিটেড ও ভারতভিত্তিক আন্তর্জাতিক কোম্পানি শিপকার্ড মেরিন বাংলাদেশ লিমিটেড স্বেচ্ছায় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে তাইওয়ানভিত্তিক মেরিল্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিসহ আরও অনেক বিদেশি কোম্পানি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিক্রি হ্রাস, সুদের উচ্চহার, শ্রম অসন্তোষ, পরিবহন ও কারিগরি সমস্যা, ডলার সংকটে কাঁচামালের ঘাটতি, বৈশ্বিক যুদ্ধ ও আকস্মিক বন্যার বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করছে ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক পালাবদলে কিছু কোম্পানির ব্যবসা করার সুযোগ কমে গেছে। রাজধানীর শপিং সেন্টারগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা কমেছে। এমনকি বাটা সু কোম্পানি যেখানে সারা বছর অগুনতি ক্রেতা থাকে চলতি বছরের শুরু থেকে তাদের ক্রেতা আনাগোনা কমে গেছে। মানুষের মনে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক কাজ করছে। তারা আগের মতো কেনাকাটা করছেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রেতারা অপ্রয়োজনে অর্থ ব্যয় সংকুচিত করেছেন।
ব্যবসাবাণিজ্য একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। ময়মনসিংহের ভালুকা ও গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকার কারখানাগুলো তীব্র গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে। ডিজেল দিয়ে কারখানা চালাচ্ছেন তারা। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছেন না। এশিয়া অঞ্চলে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ভিয়েতনামের চেয়ে ব্যবসায়িক পরিবেশ বিচারে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
যে কোনো দেশ দাঁড়িয়ে থাকে তার অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর। সেই ভিত্তি যদি নড়বড়ে হয়ে যায় দেশটির অস্তিত্বও বিপন্ন হয়। একের পর এক ব্যাংক দেউলিয়া হচ্ছে, ব্যবসায়িরা ব্যবসা গুটাচ্ছে। তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না আমাদের। যে কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে সে দেশের সরকারের ওপর। সুশাসন এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতায় শ্রীলঙ্কার আজ বেহাল দশা। পাশাপাশি চমৎকার লিডারশিপের জন্য মালয়েশিয়ার উন্নয়ন তাকিয়ে দেখার মতো।
দেশকে আসন্ন বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে হলে, সবার আগে ভাঙতে হবে সিন্ডিকেট। দ্রব্যমূল্যে আনতে হবে স্থিতিশীলতা। রাখতে হবে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমার মধ্যে। ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে ব্যবসায় ফিরিয়ে আনা দরকার। ব্যাংক-বিমা সেক্টরের দুর্নীতি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে। আদায় নিশ্চিত করতে হবে খেলাপি ঋণ। প্রতিষ্ঠা করতে হবে জবাবদিহিতা আর সুশাসন। কীভাবে করবেন, কাকে দিয়ে করবেন, সেটা সরকারের বিবেচনা।