জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম ৫ মাসেও শেষ হয়নি দুদকের অনুসন্ধান

জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম ৫ মাসেও শেষ হয়নি দুদকের অনুসন্ধান

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে অনিয়মের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের অভিযোগে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ভোট আয়োজনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সব জাতীয় নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি। কিন্তু পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও তা শেষ করতে পারেনি দুদক। এমনকি কোনো  সাবেক সিইসি কিংবা ইসি কর্মকর্তা ও তৎকালীন রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা ডিসিদের সম্পদ বিবরণীর নোটিশও জারি করেনি সংস্থাটি। গত রোববার রাতে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা গ্রেপ্তারের পর  দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়টি নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে উঠেছে নানান প্রশ্নও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুসন্ধানে দীর্ঘায়িত হওয়ার নেপথ্যে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। তাদের মতে, ধীরগতির কারণে অনেকেই গুরুতর অপরাধ করে থাকলেও ফাঁকফোকরে বের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে অনুসন্ধানের মূল উদ্দেশ্যই  নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, যেকোনো অনুসন্ধান নির্দিষ্ট সময় শেষ করার বিষয়ে দুদকের আইন ও বিধিমালায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সে অনুযায়ী কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। কিন্তু সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন নিয়ে অনিয়মের ঘটনায় দুদক বিধির ব্যত্যয় ঘটছে বলেও আলোচনা চলছে সর্বত্র। ২০০৭ সালের দুদক বিধিমালার ৭ বিধিতে বলা হয়েছে, নির্দেশ পাওয়ার পর অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে ৪৫ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে না পারলে যুক্তিসংগত কারণ উল্লেখ করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা আরও ৩০ দিন সময় নিতে পারবেন। আর ২০ (খ) অনুযায়ী, তদন্ত কর্মকর্তার অদক্ষতার অভিযোগে কমিশন আইন বা প্রযোজ্য আইনে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে দুদক।

এদিকে দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়টি বড় ও জটিল হওয়ায় সঠিক সময়ে অনুসন্ধান শেষ হয়নি। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনে (ইসি) বিভিন্ন ধরনের চিঠি পাঠানো হলেও সংস্থাটি দুদককে কোনো তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেনি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দুদক কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন কমিশনে আমরা অনেকগুলো তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু আমরা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাইনি। ঠিক এই কারণেই অনুসন্ধানটি ধীরে এগুচ্ছে। দুদক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম যেমন দিনের ভোট রাতে করা, ব্যালট জালিয়াতি, কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট  দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানোর অভিযোগ নিয়ে গত ২২শে জানুয়ারি থেকে দুদক অনুসন্ধানে নামে। অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে  প্রতিটি মহানগর, জেলা, বিভাগীয়, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মী নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা যেমন পুলিশের আইজিপি জাভেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, র‍্যাবের প্রধান বেনজীর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, তৎকালীন জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিইজি, পুলিশ সুপার, থানার অফিসার ইনচার্জ, জেলা/উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রিজাইডিং অফিসারসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তার যোগসাজশের উল্লেখ রয়েছে। ২২শে জানুয়ারি থেকে অভিযোগের অনুসন্ধানের জন্য উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে পাঁচ  সদস্যের একটি টিম কাজ করছে। 

একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কে এম নূরুল হুদার কমিশনের অধীনে। সেই কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার বিদায় বেলায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড-এর অস্তিত্ব ছিল না। যদিও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেছিলেন, জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটিং এমপিদের বিষয়ে তাদের নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল বলে মনে করি না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে? এভাবে না-অবাধ, না-সুষ্ঠু, না-নিরপেক্ষ, না-আইনানুগ, না-গ্রহণযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।’

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। সে অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই পরের তিনটি নির্বাচন হয়। প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে যায়। শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। গতবছর ডিসেম্বরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়। অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয় ওই রায়ে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, শুধু ২০১৮ সালের নির্বাচন নয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনেও ব্যাপক অনিয়ম হওয়ার অভিযোগ রয়েছে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। বিতর্কিত ও সাজানো নির্বাচন আয়োজন করে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। চলতি অনুসন্ধানের সঙ্গে বাকি নির্বাচনে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ওই সূত্রটি। এ ছাড়া ২০১৪ সালে বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি কাজী রকিবউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। সে সময় আওয়ামী লীগ একতরফা বিনাভোটে জয়ী হয় দেড়শ’র বেশি আসনে। অর্থাৎ দেড়শ’র বেশি আসনে নির্বাচন হয়নি। কিন্তু নির্বাচনের আয়োজনের জন্য রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হয়েছে।  এ বিষয়টিও রয়েছে দুদকের অনুসন্ধানের আওতায়। অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি অনুসন্ধান দুদকের কর্মকর্তারা আইন ও বিধি মেনেই করেন। এক্ষেত্রেও সেটিই করছেন। কমিশনের কাছে প্রতিবেদন জমা পড়লে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। তথ্য- মানবজমিন