‘১২ দিনের যুদ্ধে’ ইরান ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়ক্ষতি

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলিন একদা বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যে পক্ষই নিজেকে বিজয়ী দাবি করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে কেউই বিজয়ী না—সব পক্ষই পরাজিত।’ তার উক্তি অনুযায়ী বলা যায়, ইরান ও ইসরাইল উভয়ই এ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে। বাস্তবতাও বলছে— দু’দেশের অনেক সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এ যুদ্ধকে সর্বপ্রথম ‘১২ দিনের যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রতিটি যুদ্ধেরই সাধারণত একটি নাম দেওয়া হয়। এই যুদ্ধের নামটি দিলেন স্বয়ং ট্রাম্প। তিনিই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেন। এর মাধ্যমে মূলত যুদ্ধ থামানোর ‘ক্রেডিট’ বা কৃতিত্ব নিলেন তিনি।
মাত্র ১২ দিনের ভয়াবহ এই সংঘাতে ইরান ও ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে বহু স্থাপনা ও সম্পদ নষ্ট হয়েছে। স্বজন হারিয়েছেন অনেক ইরানি ও ইসরাইলি নাগরিক। তেলআবিবের হামলায় যেমন তেহরানের দুই মাসের শিশুর জীবন গেছে, তেমনি ইরানের মিসাইলের ভয়ে হার্ট অ্যাটাকেও ৫১ বছরের এক ইসরাইলি নারী মারা গেছেন।
ঘটনাপ্রবাহ
গত ১৩ জুন ইরানে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ পরিচালনা করে ইসরাইল। লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করা। ইসরাইল চায় না— ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করুক। দেশটির দাবি, ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হলে সেটা বিশ্বের জন্য হুমকি।
ইসরাইলের প্রথম ধাপের হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ সেনাপ্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার জেনারেল হোসেইন সালামি-সহ অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি নিহত হন। ইসরাইলের হামলার জবাবে পাল্টা হামলা চালায় ইরান। ১৪ ও ১৫ জুন তেলআবিব, হাইফা ও বাতয়ামে হামলা করে ইরান। এভাবে হামলা পাল্টা হামলা চলতে থাকে। দু’দেশের নিহতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
ইরানের কারাগার, আবাসিক ভবনসহ অনেক জায়গায় হামলা করে ইসরাইল। তেহরানও ইসরাইলের বীরশেভা শহরের সোরোকা হাসপাতালে আঘাত করে। দেশটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, হাসপাতালটির পার্শ্ববর্তী ইসরাইলি ঘাঁটি ইরানের হামলার লক্ষ্য ছিল।
এক পর্যায়ে যুদ্ধে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। ২১ জুন শক্তিশালী বি-২ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ইরানে ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ চালায় দেশটি। ইরানের নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করে যুক্তরাষ্ট্র। মাকিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাম্প দাবি করেন, ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনা ‘চিরতরে নিঃশেষ’ করে দিয়েছে ওয়াশিংটন।
তবে ইরানের দাবি, ফর্দো থেকে তারা আগেই ইউরেনিয়ামসহ অন্যান্য পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুতকারক দ্রব্য সরিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় তাদের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। তবে ট্রাম্প নাছোড়বান্দা। তিনি বলেন, ‘ফর্দো শেষ হয়ে গেছে।’ এখন ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার সময় হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের ওই হামলারও প্রতিবাদ করে ইরান। কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ‘অপারেশন গ্ল্যাড টিডিং ভিক্টরি’ চালায় দেশটি। এরপরই শান্তির বার্তা আসে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে। পাল্টা হামলা না করে বরং যুদ্ধবিরতির দিকে হাঁটেন তিনি। প্রথমে নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন, এরপর কাতারের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। দু’পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করেন এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
কার কী লাভ হলো
ইসরাইলের ‘লাভ’ বলতে তাদের লক্ষ্য ‘সামান্য’ অর্জিত হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের লাভ হলো— ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও তেহরানের দাবি, ওই হামলায় তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। এদিকে ইরানের ‘লাভ’ কী হলো তা নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনেক বিশ্লেষক। যুদ্ধে নিজেদের ‘অপরাজেয়’ শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে সফল হয়েছে ইরান। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছে দেশটি।
যুদ্ধের সমীকরণ অনুযায়ী, পরাজিত শক্তিই মূলত ‘সাদা পতাকা প্রদর্শন’ করে আত্মসমর্পণ করে বা যুদ্ধবিরতি চায়। কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের অবস্থাও তেমনই হয়েছে। অনেকটা তড়িঘড়ি করেই যুদ্ধবিরতির দিকে ধাবিত হয়েছেন ট্রাম্প।
তেহরানে অবস্থিত সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের গবেষক আব্বাস আসলানি মনে করেন, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানে তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। আল-জাজিরাকে তিনি জানান, যৌথ শক্তির (ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র) উদ্দেশ্য ছিল ইসরাইলের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া এবং ‘সরকার পরিবর্তন’ করা। তবে তারা কোনোটাই করতে পারেনি। এখানে রাজনৈতিকভাবে ‘দক্ষ কুশলী’র প্রমাণ দিয়েছে ইরান।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
যুদ্ধে ইরানে অন্তত ৬১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪,৭৪৬ জন। এ তথ্য জানিয়েছে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তারা আরও জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১৩ জন শিশু, যাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি ছিল মাত্র দুই মাসের। নিহতদের তালিকায় ৪৯ জন নারী রয়েছেন, যাদের মধ্যে দু’জন ছিলেন গর্ভবতী। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কেরমানপুর আরও জানান— ৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিহত, ২০ জন আহত হয়েছেন। ৭টি হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত, ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি জরুরি সেবা কেন্দ্র, ৪টি ক্লিনিক, ৯টি অ্যাম্বুলেন্স।
ইরানের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী ও দায়িত্বশীলদের মৃত্যু অনেক বড় ক্ষতি বলা যায়। এ ছাড়াও নাতাঞ্জ, ফর্দো ও ইসফাহানে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের হামলায় অনকে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা অভাবনীয়। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, ইরানের ফর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় বেশ ক্ষতি হয়েছে। যদিও ইরান তা স্বীকার করছে না।
ইসরাইলের ‘ক্ষতি’ বলতে হাইফা, তেলআবিব, বাতয়াম, বীরশেভা-সহ অনেক জায়গায় বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা করেছে ইরান। আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরাইলে নিহতের সংখ্যা ২৪ জন। আহত হয়েছেন অনেকে। দেশটি হতাতদের সঠিক সংখ্যা স্পষ্টভাবে জানায়নি। তবে ইরানের মতো ইসরাইলের শীর্ষস্থানীয় কেউ মারা গেছে বলে শোনা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির পরিমাণও খুব সামান্য। কাতারে দেশটির সামরিক ঘাঁটিতে হামলায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। কেননা হামলার আগেই তাদের সতর্ক করেছিল তেহরান।
‘অপরাজেয়’ ইরান
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে ইরানের অনেক ক্ষতি হলেও ইরান পরাজিত হয়নি। ‘অপরাজেয়’ এই ইরান ভবিষ্যতে ইসরাইলের জন্যও ‘হুমকিস্বরূপ’। ইসরাইলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগডর লাইবারম্যান বলেছেন, ইরানের সঙ্গে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ ছাড়া যুদ্ধবিরতিতে যাওয়া একটি মারাত্মক ভুল হয়েছে ইসরাইলের জন্য। এক্স হ্যান্ডলে তিনি লিখেছেন, ‘আঘাতপ্রাপ্ত সিংহকে ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু নেই।’ তিনি মনে করেন, ইরান যদি সামরিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত না হয়, তবে ভবিষ্যতে আরও বিপজ্জনক সংঘাত অনিবার্য।
এদিকে ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র আছে, ইরানের নেই। পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) সই করার কারণে এই অস্ত্র বানাতেও বাধা রয়েছে ইরানের। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশ্লেষক সৈয়দ মোহাম্মাদ মারান্দি ইজাদি আল-জাজিরাকে বলেছেন, খুব শীঘ্রই এনপিটি থেকে সরে আসতে পারে ইরান। দেশটি এ চুক্তির সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। অথচ এ সহযোগিতা কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি বরং ইরানের সেসব পারমাণবিক স্থাপনা ইসরাইলের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। কিন্তু হামলার শিকার হওয়া সব স্থাপনাই আইএইএর নিয়মিত নজরদারিতে ছিল। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এটি একেবারেই বেআইনি।
১৯৭০ সালে কার্যকর হওয়া এই চুক্তির সদস্য সংখ্যা ১৯১ টি দেশ। তবে এর মধ্যে নেই ইসরাইল, ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া। তারা এটির সদস্য না হয়ে পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো— ইসরাইল নিজে এনপিটির সদস্য না হয়েও অন্য একটি রাষ্ট্রকে এনপিটি মানতে বাধ্য করছে।