রোজার পণ্যে ভরপুর বাজারে দামও কম
প্রথম নিউজ, অনলাইন : এবার আগেভাগেই দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে রমজানের পণ্যে ভরপুর। শুধু জানুয়ারি মাসেই যে পরিমাণ আমদানি হয়েছে তা দিয়ে অনেকটা সামাল দেওয়া যাবে রোজার মাসের চাহিদা। আগের ছয় মাসেও আমদানি হয়েছে যথেষ্ট। ফেব্রুয়ারিতে খালাসের অপেক্ষায় আছে চিনি, ছোলা, ডাল, তেল, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যের আরও বড় বড় চালান। ফলে বাজারে দামও গতবছরের তুলনায় কম।
রমজানের অন্যতম অনুষঙ্গ ছোলা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চলতি ২০২৫ সালের শুধু জানুয়ারি মাসেই ছোলা খালাস হয়েছে ৯৭ হাজার ১৮১ টন। অথচ পুরো রমজানে দেশে ছোলার চাহিদা রয়েছে এক লাখ টনের মতো। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে খালাস হয়েছিল ৬৬ হাজার ৪০ টন ছোলা।
রাজস্ব বোর্ডের সূত্র বলছে, সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে প্রতিকেজি ভালোমানের ছোলা বিক্রি হয়েছে ৯২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। মধ্যমমানের ছোলা বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা কেজিতে। গত বছর রমজানের আগে একই ছোলা বিক্রি হয়েছিল ৯৩ টাকা থেকে ৯৫ টাকা কেজিতে।
শুধু ছোলা নয়, খাতুনগঞ্জসহ দেশের পাইকারি বাজারে মসুর, মটর ডালও বিগত বছরের চেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে। একইভাবে ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুনের সরবরাহও বেশি। ভোজ্যতেল বাদে প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দামও কম। পাইকারি ও আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম আর বাড়ানো না হলে পাইকারি বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন, কাস্টমস থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনায় জানা যায়, দেশে প্রতি বছর ২০-২২ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। শুধু রমজান মাসে চাহিদা থাকে ৩ লাখ টন। জানুয়ারি মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার টন। এখনো চারটি জাহাজ থেকে বন্দরে অপরিশোধিত চিনি খালাস হচ্ছে।
দেশে প্রতি বছর ভোজ্যতেলের চাহিদা ২৩ থেকে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা থাকে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন। গত জানুয়ারি মাসে আমদানি হয়েছে প্রায় ৪ লাখ টন ভোজ্যতেল।
বছরে দেশে ছোলার চাহিদা থাকে ২ লাখ থেকে ২ লাখ ২০ হাজার টন। এর মধ্যে ১ লাখ টনের মতো চাহিদা থাকে শুধু রমজান মাসে। চলতি ২০২৫ সালের শুধু জানুয়ারি মাসেই ছোলা খালাস হয়েছে ৯৭ হাজার ১৮১ টন। ফেব্রুয়ারি মাসেও ছোলা খালাস হবে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে খালাস হয়েছিল ৬৬ হাজার ৪০ টন ছোলা।
মসুর ডালের চাহিদা বছরে প্রায় সাত লাখ টন। এর মধ্যে ২ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদন হয়। বাকি ৫ লাখ টন মসুর ডাল আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা থাকে এক লাখ টনের মতো। রমজানে সমপরিমাণ মটর ডালের চাহিদা রয়েছে। কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে মসুর, মটরসহ নানান ডাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ১০৫ টন। ডলার সংকটের কারণে আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যভেদে শতভাগ এলসি মার্জিন ছিল।
বছরে খেজুরের চাহিদা প্রায় ৯০ হাজার টন। এর মধ্যে রমজানে চাহিদা থাকে ৫০ হাজার টনের কাছাকাছি। ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমদানি হয়েছে ২১ হাজার ২৬১ টন। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৬ হাজার ২৩৯ টন খেজুর। ফেব্রুয়ারি মাসে আরও বেশি খেজুর আমদানি হবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
আমদানিতে এলসি মার্জিন শিথিল ১১ নিত্যপণ্যে
অন্তর্বর্তী সরকার রমজান মাস সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ১১ ধরনের নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন শিথিল করে। গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ ধরনের একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সার্কুলারে বলা হয়েছে, এ নির্দেশনা ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বহাল থাকবে। পণ্যগুলো হচ্ছে- চাল, গম, পেঁয়াজ, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, ছোলা, মটর, মসলা ও খেজুর। তবে যেসব আমদানিকারকদের লেনদেনে স্বচ্ছতা রয়েছে তারা এলসির ক্ষেত্রে ব্যাংকের সুবিধা বেশি পাচ্ছে। এরপর থেকেই এসব পণ্য আমদানি বাড়তে থাকে।
আমদানি বাড়াতে চালের ওপর আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে এবং আগাম কর ৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ করা হয়। এরপর থেকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চালের আমদানি হচ্ছে। স্থলপথে ভারত থেকে এবং সমুদ্রপথে মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা চালের দুটি জাহাজ শিগগির চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা।
ভোজ্যতেল আমদানিতে প্রথম দফায় গত বছরের ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ক-কর কমিয়ে শুধু ৫ শতাংশ করা হয়। তবু ভোজ্যতেলের বাজারে এখনো অস্বাভাবিকতা কমেনি। পাশাপাশি আগে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ৩৮-৪০ টাকা শুল্ক-কর দিতে হতো। এখন তা কমিয়ে ২৩ টাকা করেছে সরকার। বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাবও রয়েছে।
জানুয়ারি মাসে ব্যাপক আমদানি
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৪৯০ টন, গম আমদানি ৫ লাখ ৬১ হাজার ৮৬৪ টন, ছোলা ৯৭ হাজার ১৮১ টন, মসুর, মটরসহ নানান ডাল ২ লাখ ১২ হাজার ১০৫ টন এবং খেজুর আমদানি হয়েছে ২১ হাজার ২৬১ টন।
একইভাবে জানুয়ারি মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল প্রায় চার লাখ টন এবং অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার টন।
চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ মাসে চাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৫৪৮ টন, গম ৩৩ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৫ টন, ছোলা ১ লাখ ২৫ হাজার ৫১৫ টন, পেঁয়াজ ১৬ হাজার ৪৯৬ টন, খেজুর ৭৮৭ টন এবং মসুর-মটরসহ ডাল আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৮৮ হাজার ১৫ টন।
ভোজ্যতেল বাদে সব পণ্যের দামই গতবছরের তুলনায় কম
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের তুলনায় এবার ভোজ্যতেল বাদে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম কম। খাতুনগঞ্জের মেসার্স এম কে ট্রেডিংয়ের সত্ত্বাধিকারী মুহাম্মদ রফিকুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাতুনগঞ্জের বাজারে সোমবার এস আলমের রেডি চিনি বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ ৪২৩০ টাকা। পাশাপাশি সিটি ও মেঘনা গ্রুপের চিনি বিক্রি হয়েছে ৪১৭৫ টাকা। গত বছর একই সময়ে প্রতিমণ চিনির দাম ছিল ৫ হাজার টাকার কাছাকাছি।’
তিনি বলেন, ‘সোমবার বাজারে এস আলমের সয়াবিন বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ ৬৮৬০ টাকা। সিটি গ্রুপের সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৬৯০০ টাকায়। আবুল খায়ের গ্রুপের সুপার পাম বিক্রি হয়েছে ৫৯৪০ টাকায়।’
খাতুনগঞ্জের আরেক ব্যবসাায়ী সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবছর শুধু ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। বাজারে এস আলম গ্রুপের পাম অয়েল মণপ্রতি ৫৮১০ টাকায় কিনেছি। গত বছর জানুয়ারি মাসে একই পাম অয়েলের দাম ছিল ৪৮শ থেকে ৪৯শ টাকা।’
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজান সামনে রেখে এবার প্রচুর ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম কম। এখনো দাম কমছে। খাতুনগঞ্জের বাজারে অস্ট্রেলিয়ান ছোলা রয়েছে। এসব ছোলা মানভেদে মণপ্রতি ৩৩৫০ টাকা থেকে ৩৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা থেকে ৯২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। অথচ গত বছর রমজানের আগে একই ছোলা বিক্রি হয়েছিল ৯৩ টাকা থেকে ৯৫ টাকায়।’
তিনি বলেন, ‘বাজারে অস্ট্রেলিয়ান মোটা আকারের মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯৭ টাকায়। ভারতীয় চিকন মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১২৬ টাকায়। গত বছর এসব মসুর ডালের দাম কেজিপ্রতি ১-২ টাকা বেশি ছিল। গত বছর মটর ডাল বিক্রি হয়েছিল ৫৫ টাকা কেজিতে। এখন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৯ টাকা।’
রমজানের খেজুর ও সেমাইয়ের চাহিদা থাকে বেশি। ব্যবসায়ী মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ে বাংলা সেমাই পাওয়া যায়। চট্টগ্রামে বাংলা সেমাইয়ের কদর রয়েছে। গত বছরের তুলনায় দাম অনেক কম। গত বছর যে সেমাই ২৪শ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার বিক্রি হচ্ছে ১৮শ টাকায়। গত বছর ১০ কেজি ওজনের প্যাকেটের যে খেজুর ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল, এখন একই মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৮শ টাকায়।’
চট্টগ্রাম ফল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘রমজান উপলক্ষে সরকার খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে। এলসি মার্জিনও শিথিল করা হয়েছে। এতে আমদানিকারকরা এলসি খুলেছেন। রমজানের আগেই বাজারে খেজুরের সরবরাহ আরও বাড়বে।’
খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিয়া বাজারের ব্যবসায়ী আবু তৈয়ব বলেন, ‘পাইকারি বাজারে মানভেদে ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৫৫ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এই পেঁয়াজের দাম ছিল একশ টাকার ওপরে। সোমবার দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে মানভেদে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। গত বছর দেশি পেঁয়াজের দামও কেজিপ্রতি ৮০ টাকার বেশি ছিল। কেরালা আদা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৭০-৮০ টাকা কেজিতে।’
খাতুনগঞ্জের লামার বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন বাজারে পেঁয়াজ, রসুন, আদার সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। রমজান সামনে রেখে এসব পণ্যের সংকটের আশঙ্কা নেই। তবে দাম ৪-৫ টাকা বেশি বা কম হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন গম নিয়ে আসা ১২টি জাহাজ খালাসরত। বহির্নোঙরে ব্রাজিল থেকে আসা দুটি জাহাজ থেকে ‘র’ চিনি খালাস হচ্ছে। এর মধ্যে এমভি এস-ব্রিজ জাহাজে ৪৪ হাজার ১১৭ টন এবং এমভি এইমস লিডার জাহাজে ৫৫ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি রয়েছে। পাশাপাশি ৫৮ হাজার ৩৪৪ টন ‘র’ চিনি নিয়ে ব্রাজিল থেকে এমভি এভা সাংহাই নামে ও ৫৬ হাজার ৩শ টন ‘র’ চিনি নিয়ে এমভি সিগুল নামে আরেকটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে শিগগির।
ব্রাজিল, আমেরিকা, কানাডা, আর্জেন্টিনা থেকে পাঁচটি জাহাজে আসা ২ লাখ ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল খালাস হচ্ছে। একই সময়ে ৬০ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন নিয়ে আসা ‘এমভি সুবরা’ জাহাজাটি খালাস শেষে ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করেছে।
অন্যদিকে ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে কানাডা, ইউক্রেন এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা ১১টি জাহাজ থেকে ছোলা, মসুর ডাল ও মটর খালাস হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের বড় আমদানিকারক ব্যবসায়ী বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘সামনের রমজান ঘিরে এবার প্রচুর ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। নতুন নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছে। বাজারে সরবরাহও রয়েছে প্রচুর। সবমিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে যদি ডলারের দাম বাড়ানো না হয়, নতুন করে শুল্ক আরোপ করা না হয়, তাহলে রোজায় পাইকারি বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। পাইকারি বাজারে পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’