বন্যা পরিস্থিতির অবনতি: ময়মনসিংহে মানুষ ছুটছে আশ্রয়কেন্দ্রে

গতকাল জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি: ময়মনসিংহে মানুষ ছুটছে আশ্রয়কেন্দ্রে

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলায় অবনতি হয়েছে। ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ৩ উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের  লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক। গতকাল জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, হালুয়াঘাটের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে বতর্মানে নারী-শিশুসহ দেড় সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ৩ উপজেলায় ৩০ টন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে।

এ ছাড়া রান্না করা খাবারও দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানায়, ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর, জিগাতলাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে পুরো উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। দুর্গতদের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি অনেক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছে। খাবার কিনতে বের হওয়া উপজেলার কাওয়ারকান্দা  গ্রামের সফিকুল ইসলাম  বলেন, রাস্তাঘাটে ও ঘরে পানি উঠে গেছে। কোথাও কোনো শুকনা খাবার পেলাম না।  আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন।

স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, এমন বন্যা আগে কখনো দেখি নাই। ১৯৮৮ সালের বন্যা দেখেছি, তখন এমন পানি ছিল না। বাড়িঘরে পানি উঠেছে। গরু-ছাগল নিয়ে বিপদে আছি। গরু পানির মধ্যে বাঁধা। আমরা খুব সমস্যায় আছি। চলাফেরা খুব কষ্ট হয়, রাস্তায় বুকসমান পানি। এদিকে, ফুলপুর উপজেলার ছনধরা, রামভদ্রপুর, সিংহেশ্বর, ফুলপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ও অন্যান্য ইউনিয়নের আংশিক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার আমন ফসল ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের খামার। উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকারাস্তা, ঘোষগাঁও-ধোবাউড়া পাকারাস্তা, ঘোষগাঁও-বালিগাঁও পাকারাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকারাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

জেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, ধোবাউড়া উপজেলায় নিমজ্জিত হয়েছে ১১ হাজার ৭০০ হেক্টর ধানের জমি। এর মধ্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ৪ হাজার ২০০ হেক্টর ও সবজি ৬০ হেক্টর। হালুয়াঘাটে নিমজ্জিত হয়েছে ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর। এর মধ্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ৪ হাজার ১০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর ও সবজি ৭৫ হেক্টর। ফুলপুরে নিমজ্জিত হয়েছে ৩ হাজার ৬৩০ হেক্টর। এর মধ্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ১ হাজার ৪৮০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ২ হাজার ১৫০ হেক্টর ও সবজি ৬২ হেক্টর।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ৭ হাজার ৮০ জন মৎস্যচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে ২১৭ লাখ, ভেসে গেছে ৫ হাজার ৬২৪ লাখ টাকার মাছ ও রেণুপোনা ভেসে গেছে ১৪৯ লাখ টাকার। মৎস্যখাতে মোট ৫ হাজার ৯৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

পূর্বধলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ২৫ গ্রাম প্লাবিত
পূর্বধলা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার পূর্বধলার, জারিয়া আনসার ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে নাটের কোনা নামক স্থানে কংস নদীর বেড়ীবাঁধ ভেঙে অন্তত ২৫টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে গত রোববার সন্ধ্যার পর থেকে  বন্যার পানি ঢুকেছে। গ্রামের রাস্তা, পুকুর, ঘরবাড়ি ও বিদ্যালয় প্লাবিত হয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। গত রোববার  বেলা ১১টায় পূর্বধলার জারিয়া কংস নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রমে পূর্বধলার ৩টি ইউনিয়নে বেড়ীবাঁধের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। উপজেলার জারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম নান্টু মণ্ডল  মানবজমিনকে বলেন, জারিয়া ইউনিয়নটি নিচু এলাকা। ইউনিয়নে জারিয়া, বারহা, মৌদাম, নাটের কোনা, সালদিঘা, ধনিয়া কান্দা, গুজাখালীকান্দা  পাহাড়ি পানিতে পুরো গ্রাম কবলিত হয়েছে। বাজারে পানির কারণে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারছেন না।

বারহাট্টায় পানির নিচে ফসলি জমি
বারহাট্টা (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি জানান, গত কয়েক দিনের  বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে ইতিমধ্যেই পানিবন্দি হয়েছে বারহাট্টা উপজেলার ২নং সাহতা ইউনিয়ন, রায়পুর ইউনিয়ন, আসমা ইউনিয়ন ও চিরাম ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের মানুষ। ধানের ওপর নির্ভরশীল এই অঞ্চলের নিচু ফসলি জমি তিনদিন ধরে পানির নিচে থাকায় পচন ধরা শুরু হয়েছে। কৃষকরা এখন পানির নিচ থেকে ধান গাছ কেটে গরুর জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তাই এত কষ্টের ফসল ধান এখন গরুর খাদ্য হচ্ছ। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে উপজেলার  মাছ চাষিরাও। দুইদিন ধরে মাছ ধরে রাখার চেষ্টা করে আজ ৭ই অক্টোবর সোমবার হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

দৌলতপুরে ৩৬ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি
দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে অতি বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানিতে চরাঞ্চলের ৩৬ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। এতে তলিয়ে যায় ফসলের মাঠ। জলাবদ্ধতার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্ধ করা হয় শিক্ষা কার্যক্রম। গত দুই সপ্তাহ ধরে এমন অবস্থায় মানবেতর দিন কাটছে রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়নের পানিবন্দি অসহায় হাজারো পরিবার। এরমধ্যে যোগ হয়েছে পদ্মার তীব্র ভাঙন। ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে পদ্মাপড়ের মানুষ। হুমকির মুখে পড়েছে বিজিবি ক্যাম্প। চিলমারীর উদয়নগর বিজিবি ক্যাম্প থেকে সামান্য দুরে পদ্মা নদী। যেকোনো মুহূর্তে নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে উদয়নগর বিজিবি ক্যাম্প এমনটি জানিয়েছেন বিজিবি সদস্য ও বন্যাকবলিত চরবাসী। 

রামকৃষ্ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ মণ্ডল জানান, গত দুই সপ্তাহ ধরে রামকৃষ্ণপুর ও চিলমারী ইউনিয়নের ৩৬ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। তলিয়ে গেছে উঠতি ফসল মাসকলাইসহ ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। এরপর নতুন করে যোগ হয়েছে পদ্মার ভাঙন। তাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে পানিবন্দি অসহায় চরবাসী।