বিচ্ছেদের পর স্বামীর সঙ্গে ফের বিয়ে, ‘নির্যাতনে’ কিশোরীর মৃত্যু

ঘটনাটি দেড় লাখ টাকায় মীমাংসার জন্য গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী চাপ দিচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।

বিচ্ছেদের পর স্বামীর সঙ্গে ফের বিয়ে, ‘নির্যাতনে’ কিশোরীর মৃত্যু
নিপা দাস

প্রথম নিউজ, টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া নিপা দাসকে নির্যাতনের পর শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি দেড় লাখ টাকায় মীমাংসার জন্য গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী চাপ দিচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার অনাইতারা মামুদপুর গ্রামের মৃত রতন চন্দ্র দাসের মেয়ে নিপা দাসকে গ্রামের লোকজন গত আড়াই বছর আগে ১৩ বছর বয়সে পাশের বাড়ির পবন দাসের ছেলে মানিক চন্দ্র দাসের সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের তিন-চার মাস পর থেকে নিপার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালান স্বামী। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রায় দেড় বছর সংসারের পর ডিভোর্সের মাধ্যমে মানিকের কাছ থেকে নিপাকে ছাড়িয়ে আনেন।

গত সাত মাস আগে গ্রামের লোকজন পুনরায় মানিকের সঙ্গে মন্দিরে নিপার বিয়ে দেন। বিয়ের পর নিপার ওপর আবারোও নির্যাতন চালানো শুরু করেন মানিক। ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মানিক বাড়ির লোকজনের উপস্থিতে নিপাকে বেদম মারধর করেন। সন্ধ্যার দিকে মানিক বাড়ির লোকজনকে জানান, গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে নিপা। এ বলে নিপার মরদেহ ঘরের বাইরে আনেন মানিক। খবর পেয়ে মির্জাপুর থানা পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।

এদিকে ঘটনাটি মীমাংসার জন্য গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি উঠেপড়ে লাগেন। তারা নিপার মা আন্না দাসকে নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনাইতারা ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান, সদস্য, গ্রামের লোকজন ও উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে সালিশি বৈঠক হয়। সাদা কাগজে নিপার মা আন্না দাসের স্বাক্ষর নিয়ে দেড় লাখ টাকায় রফা করা হয়। বৈঠকে ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে ৫০ হাজার টাকাও জমা দেন মানিক। কিন্তু আপসে জাননি নিপার মা আন্না দাস।

নিপার পার্শ্ববর্তী বাড়ির রেবেকা বেগম বলেন, ‘নিপা ভদ্র ও মেধাবী একজন ছাত্রী ছিল। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। আইনের মাধ্যমে তার স্বামী মানিকের শাস্তি দাবি জানাচ্ছি। নিপার খালা কাকন চন্দ্র দাস, মামাতো ভাই দীপংকর বলেন, ‘টাকা দিয়ে জীবন পাওয়া যায় না। হাত পা বেঁধে শ্বাসরোধে নিপাকে হত্যা করা হয়েছে। তার ঘাড়ও ভেঙে ফেলা হয়। নিপার বৃদ্ধা নানি দুলালী চন্দ্র দাস কান্না করতে বলেন, ‘এর আগেও নৌকার মধ্যে নিয়ে আমার নাতনিকে খুন করার চেষ্টা করে মানিক।’

নিপার মা আন্না চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমি চন্দ্রা এলাকার একটি মোজা কারখানায় চাকরি করি। নিপা বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতো। গ্রামের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানিকের সঙ্গে ১৩ বছর বয়সে নিপাকে বিয়ে দিতে বাধ্য করে। বিয়ের পর নির্যাতন চালানোয় ডিভোর্স দিয়ে মেয়েকে বাড়িতে আনি। ওই সময় ৪০ হাজার টাকা ধার্য হলেও মাতাব্বররা ১০ হাজার টাকা রেখে আমাদের ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিল। কয়েক মাস পর তারা না জানিয়ে আবার মানিকের সঙ্গে নিপাকে মন্দিরে বিয়ে দেন।’

তারা কারা নাম জানতে চাইলে বলেন, ‘নাম বললে আবার নতুন করে বিপদে পড়তে হবে। আমরা টাকা চাই না, আইনের মাধ্যমে খুনি মানিকের শাস্তি চাই। আমরা নিরীহ হওয়ায় কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাই। অভিযুক্ত মানিক চন্দ্র দাস ও তার বাবা পবন চন্দ্র দাস গা ঢাকা দেওয়ায় তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মানিকের চাচা গোবিন্দ চন্দ্র দাস ও ফুপা সুনিল চন্দ্র দাস বলেন, দুই শতাংশ জমি বিক্রি করে ডিভোর্স দেয়া হয়েছিল। কয়েকমাস আগে গ্রামের লোকজন আবার তাদের বিয়ে দেন। নিপা মারা যাওয়ার পর চেয়ারম্যান দেড় লাখ টাকায় ঘটনাটি মীমাংসা করে দিয়েছেন।

এ বিষয়ে আনাইতারা গ্রামের মাতাব্বর মো. ময়নাল হোসেন বলেন, নিপার পরিবারকে কেউ ভয়ভীতি দেখায়নি। স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. বজলু মিয়া বলেন, ‘দুই পরিবারের লোকজন ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে আসার পর মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা মোস্তফা কামাল ময়নাল বলেন, উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য সালিশি বৈঠকে মানিককে নিপার পরিবারকে দেড় লাখ টাকা দিতে বলা হয়েছে। মানিক ৫০ হাজার টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা দিতে তিনদিনের সময় নিয়েছিল। নিপার মা টাকা নিবে না, মামলা করবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, বিষয়টি একান্তই তাদের বিষয়। আমার কাছে দুই পক্ষই কথা বলায় মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে মাত্র।

এ বিষয়ে মির্জাপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. হাবিবুর রহমান উকিল বলেন, আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর জানা যাবে এটি হত্যা না আত্মহত্যা।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom