প্রণোদনা পেতে ২১ প্রতিষ্ঠানের ৪৫২ কোটি টাকার ভুয়া রপ্তানি

২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪২টি চালান রপ্তানি দেখিয়ে এ প্রণোদনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রণোদনা পেতে ২১ প্রতিষ্ঠানের ৪৫২ কোটি টাকার ভুয়া রপ্তানি
ফাইল ফটো

প্রথম নিউজ, ঢাকা: কৃষিপণ্য রপ্তানির বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬.২ কোটি টাকার প্রণোদনা নিয়েছেন ঢাকার ফকিরাপুলের মামুন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪২টি চালান রপ্তানি দেখিয়ে এ প্রণোদনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়াতে সরকারের  দেওয়া এ প্রণোদনা সুবিধা প্রতিষ্ঠানটি নিতেই পারে। তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে কোনো পণ্যই রপ্তানি করেনি প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি এ ধরনের ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে প্রণোদনা নেওয়ার চিত্র তথ্য উঠে এসেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের তদন্তে।

শুধু মামুন এন্টারপ্রাইজ নয়, আরও অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠান একইভাবে ৪৫১ দশমিক ৫ কোটি টাকা মূল্যের ৯৬৫টি চালান রপ্তানি না করেই বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করেছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, রপ্তানি না করলেও এসব চালানের বিপরীতে অন্তত ১৮২ কোটি টাকা দেশে প্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে ১৭টি প্রতিষ্ঠান প্রায় সাড়ে ৩৩ কোটি টাকা প্রণোদনাও গ্রহণ করেছে।

কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো সবগুলো ব্যাংকের তথ্য পাওয়া যায়নি। অবৈধভাবে প্রণোদনা নেয়ার পরিমাণ ৯০ কোটি টাকা হতে পারে বলে আশঙ্কা  করছেন তারা। রপ্তানি না করেও এলসির বিপরীতে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে অর্থ আসায় এ ঘটনায় ব্যাংকেরও দায় থাকতে পারে বলে মনে করছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। তবে কাস্টমসের নথিতে ব্যাংকের দায়ের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

কাস্টমসের নথি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালের মে থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এ ধরনের জালিয়াতি করে এলেও তা সম্প্রতি ধরা পরে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের ইউজার আইডি ব্যবহার করে এসব রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করেছেন অন্তত ২০টি সিএন্ডএফ এজেন্ট। এসব চালান চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ না করলেও তা এনবিআরের সার্ভারে রপ্তানি দেখানো হয়েছে। যা ব্যবহার করে পরবর্তীতে প্রণোদনা পেয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। অস্তিত্বহীন এসব চালানগুলিকে কৃষিপণ্য বা প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন আলু, তিল বীজ, লাল মরিচ, হলুদ, টমেটো, ধনে গুঁড়া এবং বিরিয়ানি মসলা দেখানো হয়েছে। এসব পণ্য রপ্তানির উপর ২০ শতাংশ হারে প্রণোদনা পেয়ে থাকে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। 

তদন্তকারীরা বলেছেন, রপ্তানিকারক ও তাদের এজেন্টদের পাশাপাশি কিছু কাস্টমস কর্মকর্তারা এতে জড়িত থাকতে পারে। এ চক্রটি এনবিআরের সার্ভারে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে নিজেদের ইচ্ছেমতো চালান তৈরি ও রপ্তানি সম্পন্ন হয়েছে মর্মে সার্ভারে দেখিয়েছে। এনবিআর দেশের আমদানি রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য কর্মকর্তাদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে থাকে। একটি বৈধ আইডি এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে সিস্টেমটিতে দেশের যে কোনো জায়গা থেকে প্রবেশ করা যায়। কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইলিয়াস মামুন মিয়াজীর মালিকানাধীন মামুন এন্টারপ্রাইজ এবং মিয়াজী ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড প্রায় ৯৯ কোটি টাকার ২০৫টি চালান রপ্তানি করেছে। সাতটি ব্যাংকের তিনটি থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, তারা প্রণোদনা হিসেবে ৭.৬১ কোটি টাকা নিয়েছে।

কাস্টম নথি অনুযায়ী রাজধানীর ফকিরাপুলের ইনার সার্কুলার রোডের শতাব্দী সেন্টারে মামুন এন্টারপ্রাইজের অবস্থান। গত ২০ মার্চ দ্য ডেইলি স্টার সেখানে জননী এন্টারপ্রাইজ নামে আরেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুঁজে পায়। সেখানে চার বছর ধরে কর্মরত একজন গার্ড জানান, এ ভবনে মামুন এন্টারপ্রাইজ নামে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল না। ভৌতিক রপ্তানি সম্পর্কে জানতে চাইলে মামুন বলেন, তাদের কিছু চালান কীভাবে এনবিআর সার্ভারে 'রপ্তানি' দেখানো হয়েছে তার কোনো ধারণা নেই। 'আমরা প্রণোদনা বাবদ মাত্র সাত থেকে আট কোটি টাকা পেয়েছি এবং এর মধ্যে কিছু পণ্য আমরা প্রকৃতপক্ষেই রপ্তানি করেছি। নথিতে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

একইভাবে ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার প্রণোদনা নিয়েছে অপর দুটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ডিও এম্পেক্স লিমিটেড এবং এমবি এগ্রো ফুড প্রোডাক্ট। যোগাযোগ করা হলে ডিও এম্পেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান জিয়া হায়দার মিঠু প্রথমে এই প্রতিবেদককে পরে ফোন করতে বললেও পরে ফোন ধরেননি। এমবি এগ্রো ফুড প্রোডাক্টের মালিক মোশতাক খান জালিয়াতির সাথে তার কোম্পানির জড়িত থাকার বিষয় স্বীকার করেছেন। তবে তিনি এটি অন্যায় কিছু নয় বলেও দাবি করেন। তিনি বলেন, পণ্য রপ্তানি না হলেও কয়েক কোটি টাকা দেশে ঢুকেছে, যা বৈদেশিক রিজার্ভ বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে।

যেভাবে ভুয়া রপ্তানি ধরে কাস্টমস: গত বছরের নভেম্বরে 'চট্টগ্রাম বন্দর: ফ্যান্টম এক্সপোর্ট রাইজ অ্যালার্ম' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দুটি প্রতিষ্ঠান ভুয়া রপ্তানি দেখাতে কীভাবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ইউজার আইডি ব্যবহার করা হয়েছে তার তথ্য তুলে ধরা হয়। তিন মাস পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে কেলেঙ্কারির বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে চিঠি দেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম।

তিনি চিঠিতে বলেন, 'কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান শুল্ক কর্মকর্তা এবং সিএন্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্টদের সহায়তায় ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা নিচ্ছেন। তদন্তে দেখা গেছে যে, এসব পণ্য আইসিডি বা বন্দরেই প্রবেশ করেনি। চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি এবং অর্থপাচারের মামলা দায়ের করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। চিঠির সঙ্গে ১৮ রপ্তানিকারকের ৮৭২টি জাল চালানের বিস্তারিত তালিকা সংযুক্ত করেছে কাস্টমস। পরবর্তীতে তদন্ত কর্মকর্তারা অন্য তিন রপ্তানিকারকের আরও ৯৩টি ভৌতিক চালান শনাক্ত করে। তদন্ত কার্যক্রম চলমান আছে জানিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত তথ্য আরও বেশি হবে যা তদন্ত শেষে বলা যাবে।

কাস্টম কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, 'ভুয়া রপ্তানি হওয়া পণ্যের সবগুলোই যেসব পণ্যের নাম বলা হয়েছে তা ২০ শতাংশ প্রণোদনার অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ প্রণোদনার টাকা হাতিয়ে নিতেই এ ধরনের জালিয়াতি করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে যেসব প্রতিষ্ঠানের সম্পৃকক্তা পেয়েছি তাদের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। এনবিআরের সদস্য ( রপ্তানি-বন্ড ও আইটি) হোসাইন আহমেদ বলেন, প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত প্রতারকদের যে কোনো প্রণোদনা প্রদান স্থগিত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কী আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় তা বিবেচনা করা হচ্ছে। অবৈধভাবে দেশে ডলার আনার জন্য আমরা তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করবো।'

যেভাবে সার্ভারে ভুয়া রপ্তানি দেখানো হয়েছে: সাধারণত, রপ্তানি চালানে ব্যাংকে এলসি খোলার পর তা জাহাজীকরণের আগে চট্টগ্রাম কাস্টমসে বিল অফ এক্সপোর্ট নম্বর তৈরি করতে হয়। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বিল অফ এক্সপোর্ট এনবিআরে সার্ভারে দাখিল করেন তাদের মনোনিত সিএন্ডএফ এজেন্ট। তারপর রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রামে অবস্থিত কনটেইনার ডিপোগুলোতে এনে শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে এসব পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে জাহাজীকরণের মাধ্যমে গন্তব্য পৌঁছায়। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন ডিপোতে থাকা কাস্টমস কর্মকর্তাদের দ্বারা তা সার্ভারে রপ্তানি হয়েছে মর্মে জানানো হয়।  জালায়াতি চক্রটি কাস্টমস কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে সার্ভারে ঢুকে এসব চালান রপ্তানি হয়েছে মর্মে দেখাতে সক্ষম হয়েছে। কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার আবুল কাশেম বলেন, তিন থেকে চার ধাপে এনবিআরের সার্ভারে তথ্য আপলোড করতে হবে। এ ধরনের প্রক্রিয়া আমদানি পণ্য চালান হয়ে থাকলেও রপ্তানিতে কেবল এক ধাপেই সব কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে জালিয়াতি হওয়ার সুযোগ বেশি।

কীভাবে রপ্তানি না করেও টাকা এসেছে : রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে প্রণোদনা দাবি করার জন্য এনবিআর সার্ভারে রপ্তানির তথ্য অন্যান্য নথির সাথে দাখিল করতে হয়। যা তারা তাদের লিয়েন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে করে থাকে। ব্যাংক, সিএন্ডএফ এজেন্ট এবং রপ্তানিকারক সংস্থা সূত্র জানা গেছে, ভুয়া রপ্তানির ক্ষেত্রে, রপ্তানিকারক এবং তাদের সিএন্ডএফ এজেন্টরা আমদানিকারক দেশে একটি অফিস ব্যবহার করে। এই অফিসগুলি কখনও কখনও সেসব দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে, তাদের সরকার প্রদত্ত তুলনায় বেশি নগদ প্রণোদনা দেয়া হয়। সংগ্রহকৃত এসব অর্থ ভুয়া রপ্তানির নামে খোলা এলসির বিপরীতে দেশে পাঠিয়ে দেখা হয়। যা থেকে পরবর্তীতে প্রণোদনা গ্রহণ করে এ চক্রটি। 'তারা যে অর্থ পাঠায় তা আসলে বাংলাদেশি প্রবাসীদের রেমিটেন্স,' নাম প্রকাশ না করে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন।

যেসব দেশে ভুয়া রপ্তানি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পণ্যের গন্তব্য হিসেবে মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর এবং সৌদি আরব দেখানো হয়েছে। এসব দেশগুলিতে লাখো বাংলাদেশি অভিবাসী বাস করে। জানতে চাইলে কাস্টমস কমিশনার বলেন, কীভাবে রপ্তানি আয় দেশে প্রবেশ করেছে তা তারা জানেন না। তিনি বলেন, 'এটির গভীর তদন্ত প্রয়োজন। আমরা এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে এটি তদন্ত করার জন্য অনুরোধ করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কোনো প্রণোদনা দেওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দল রপ্তানিকারক কোম্পানির তথ্য যাচাই-বাছাই করে। তিনি বলেন, 'ভুয়া রপ্তানি দেখিয়ে প্রণোদনা পাওয়ার সুযোগ নেই। পণ্য রপ্তানি না করে কীভাবে দেশে টাকা ঢুকল তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রণোদনা ও অবৈধভাবে দেশে অর্থ প্রবেশের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও  অডিট ফার্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।