সাব-ইন্সপেক্টরকে সমীহ করে চলতেন এসপি, কে সেই পুলিশ সদস্য

কুমিল্লা জেলা পুলিশের সাবেক রিজার্ভ অফিসার (আরও-১) এসআই জয়নাল আবেদীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আস্তানা গাড়েন জেলা পুলিশে।

সাব-ইন্সপেক্টরকে সমীহ করে চলতেন এসপি, কে সেই পুলিশ সদস্য

প্রথম নিউজ, কুমিল্লা :  কুমিল্লা জেলা পুলিশের সাবেক রিজার্ভ অফিসার (আরও-১) এসআই জয়নাল আবেদীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আস্তানা গাড়েন জেলা পুলিশে। নিয়োগ, বদলি ও নানা তদবির বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এদিকে ক্ষমতার দাপটে শুধু দুর্নীতি নয়, নারী পুলিশ সদস্যদের উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানি করতেন। শেখ হাসিনার বিতর্কিত পিওন জাহাঙ্গীরকে প্রটোকল দিয়ে কুমিল্লায় এনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতেন।  পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হলেও জেলার এসপি পর্যন্ত তাকে সমীহ করে চলতেন।

জয়নাল আবেদীন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। পুরো জেলার পুলিশের এসআই, এএসআই, কনস্টেবল পদে বদলির প্রস্তাব তৈরি ও তদারকি করেন আরও-১। আর এ পদে বসে কুমিল্লা, ঢাকা ও নোয়াখালীতে স্ত্রী, শ্বশুর, স্বজন ও নিজ নামে বিপুল সম্পদ গড়েছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪০০ কোটি টাকার পিওন জাহাঙ্গীর আলমের ‘ভাতিজা’ পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হলেও জেলার এসপি পর্যন্ত তাকে সমীহ করে চলতেন। নিয়োগ, বদলি ও নানা তদবির বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এদিকে ক্ষমতার দাপটে শুধু দুর্নীতি নয়, নারী পুলিশ সদস্যদের উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানি করতেন। বেশ কয়েকজন নারী কনস্টেবল তার হেনস্তার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি কোনো ভিকটিম।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার খিলপাড়ার বাসিন্দা পুলিশের সাব-ইনস্পেকটর জয়নাল আবেদীন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আস্তানা গাড়েন কুমিল্লা জেলা পুলিশে। জেলার একাধিক ইউনিটে চাকরি করার পর বিয়ে করেন নাঙ্গলকোট থানার ভুশ্চি এলাকায়। পরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিওন জাহাঙ্গীর আলমের প্রভাবে জেলার গুরুত্বপূর্ণ আর.ও-১-এর পদ বাগিয়ে নেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আর.ও-১ পদে বসে জয়নাল এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল পদে বদলি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। গুরুত্বপূর্ণ থানা, ফাঁড়ি, তদন্তকেন্দ্র এবং বিভিন্ন ইউনিটে পোস্টিং বাণিজ্য করে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। কোনো পুলিশ সদস্য কিংবা কর্মকর্তা তার চাহিদা অনুসারে ঘুস না দিলে পোস্টিং দেওয়া হতো পাহাড়ি অঞ্চলে। জেলার সব থানা ফাঁড়ি ও তদন্তকেন্দ্রে ক্যাশিয়ার ও মুনশিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন। মাদকসহ বিভিন্ন মামলার তদবির করতেন।

ভুক্তভোগী এক সাব-ইনস্পেকটর বলেন, আর.ও-১ জয়নাল সকালে ভুয়া বদলির আদেশ দেখিয়ে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিকালে তা প্রত্যাহার করে নিতেন। এসআই টিপু বিশ্বাস বলেন, আর.ও-১ জয়নাল আমাকে হয়রানি করে এক মাসে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসআই মোহাম্মদ সোহেল বলেন, আমার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে এক মাসের মধ্যে আবার আমাকে জেলা থেকে আউট করে দিয়েছেন।

কুমিল্লা পুলিশ অফিস সূত্র জানায়, এসআই জয়নাল ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫ বছর আরও-১ পদে বহাল ছিলেন। দায়িত্ব পালনকালে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তাকে দফায় দফায় বদলির আদেশ করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। তিনি মাঝেমধ্যে শেখ হাসিনার বিতর্কিত পিওন জাহাঙ্গীরকে প্রটোকল দিয়ে কুমিল্লায় এনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতেন। ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে পদাবনতি দেওয়া হয়। এসআই থেকে তিন বছরের জন্য এএসআই করা হয়। পরে পিওন জাহাঙ্গীরের প্রভাবে দেড় বছরের মধ্যে আবারও এসআই পদে বহাল করা হয়।

ওই বছরই রংপুরে পোস্টিং করা হয়। সেখানে থানা এবং ডিএসবি মিলিয়ে চার বছর দাপিয়ে বেড়ান। পরে ২০২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলি করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশে যোগদানের পরপরই নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে তাকে আবারও ক্লোজ করা হয়। তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দুটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। প্রায় এক বছর জেলা পুলিশের কন্ট্রোল রুমে সংযুক্ত থাকার পর আবার প্রভাব খাটিয়ে আশুগঞ্জ থানায় পোস্টিং নেন। বর্তমানে ওই থানার সেকেন্ড অফিসার পদে দায়িত্বরত আছেন এসআই জয়নাল।

কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও এলাকার বাসিন্দা ইফতেখার আহমেদ বলেন, এসআই জয়নালের বাগিচাগাঁও এলাকায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের ৪ তলা একটি বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে। বেক্সিমকো ফার্মার কাছে ভবনটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নগরীর পৃথক এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে। নাঙ্গলকোট উপজেলার ভুশ্চি এলাকার মোবারক হোসেন বলেন, চতুর জয়নাল শ্বশুরের নামে বিঘায় বিঘায় কৃষিজমি ক্রয় করেছেন। ২০-৩০ বিঘার নিচে হবে না। তার শ্বশুর একজন স্কুলশিক্ষক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জয়নালের ব্যাচম্যাট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নিজ এলাকা নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার খিলপাড়ায় বাড়ি, দামি জায়গা এবং বিঘায় বিঘায় কৃষিজমি ক্রয় করেছেন। ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট কিনেছেন। তাছাড়া নগদ অর্থ এবং সোনা-গহনা রয়েছে। তিনি কমপক্ষে শতকোটি টাকার মালিক। কুমিল্লা জেলার আর.ও-১ পদে বসে দুর্নীতি করে এসব সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি।

অভিযোগ অস্বীকার করে এসআই জয়নাল আবেদীন বলেন, ষড়যন্ত্র করে নারী দিয়ে বারবার আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। এসব ঘটনায় আমি বিভাগীয় পানিশমেন্ট ভোগ করেছি। কুমিল্লায় আমার একটি বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে, এটি সত্য। তবে শতকোটি টাকার মালিক নই আমি। এটি যারা বলেছে, সঠিক বলেনি।