শিশুসুরক্ষার আইন আছে প্রয়োগ নেই
প্রথম নিউজ, ঢাকা: যাত্রাবাড়ীর এক ধর্ষণ মামলার বিচার চলছিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে। সেখানে জাহিদ (ছদ্মনাম) নামে এক শিশু আসামিকেও আনা হয় হাজিরার জন্য। তাকে নিয়ে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ইউনিফর্ম পরে এজলাসের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধর্ষণ মামলার বিচার শেষে শিশুরটির হাজিরা নেন আদালত। এরপর তাকে গাজীপুর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে নিয়ে যান ওই পুলিশ সদস্য।
গত ১৩ জুলাই ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে কোমরে দড়ি বেঁধে কয়েকজন আসামিকে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল। আসামিদের মধ্যে একজন শিশু আসামিও ছিল। তার কোমরে দড়ি কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সদস্য বলেন, আসামি চলে গেলে কি আপনি ধরে দেবেন। নিরাপত্তার স্বার্থেই তার কোমরে দড়ি বাঁধা হয়েছে।
ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এভাবে শিশু অপরাধীদের বিচার হয়। আদালতকক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রয়োজনে বিশেষ ধরনের আসনের বিষয়টি নিশ্চিত করার কথা রয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, শিশুদের জন্য আলাদা কোনো আসন বা এজলাসও নেই। লালসালু ঘেরা আদালতকক্ষে দাগি আসামিদের সঙ্গে একই এজলাসে বিচার চলছে শিশু আসামিদের।
২০১৩ সালের শিশু আইনের ১৯(৩) ধারায় বলা হয়েছে, ‘উপ-বিধি (১) এর সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ করিয়া আদালতকক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রয়োজনে বিশেষ ধরনের আসন প্রদানের বিষয়টি শিশু-আদালত নিশ্চিত করিবে।’ শিশু আইনের ১৯ (৪)ধারায় বলা হয়েছে, ‘অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু-আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালীন, আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালতকক্ষে তাহাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরিধান করিতে পারিবেন না। গ্রেফতার করিবার পর কোনো শিশুকে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাইবে না।’
দাপ্তরিক ইউনিফরম পরে কোনো শিশুকে আদালতে না আনার কথা থাকলেও আইনের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে একদিকে শিশু আইনের বিধানকে অমান্য করা হচ্ছে, অপরদিকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা।
কোনো শিশুকে শ্রমে নিযুক্ত করলে জরিমানার বিধান থাকলেও এর বাস্তবায়ন খুবই কম। নিয়োগকর্তারা কম পারিশ্রমিকে অধিক লাভের আশায় শিশুদের শ্রমে নিয়োগ করছেন। শিশুরাও আর্থিক সচ্ছলতার আশায় শেষ করছে তাদের সোনালি শৈশব-কৈশোর। শ্রম আইনের ২৮৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি কোনো শিশু বা কিশোরকে চাকরিতে নিযুক্ত করে অথবা এ আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করিয়া কোনো শিশু বা কিশোরকে চাকরি করিবার অনুমতি দেন তাহলে তিনি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’ শ্রম আইনের ২৮৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো শিশুর পিতা-মাতা বা অভিভাবক বিধান লঙ্ঘন করে কোনো শিশু সম্পর্কে চুক্তি সম্পাদন করিলে তিনি এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
শিশু মাজেদুল (ছদ্মনাম) রাজধানীর গুলিস্তান থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জের কতমতলীর একটি লেগুনায় সহকারীর কাজ করে। লেগুনায় বসা স্কুলপড়ুয়া এক শিশু মাজেদুলকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি স্কুলে না গিয়ে হেলপারি করছো কেন। মাজেদুল উত্তরে বলে, ভাই তোমার মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে আমি জন্ম নেইনি। দিন শেষে বাড়িতে টাকা না নিয়ে গেলে আমার ভাত জোটে না। বাবা অসুস্থ, মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। দুই বোন আছে আমার। আমি টাকা না নিয়ে গেলে তাদেরও খাবার জোটে না। দিনে আমাকে দুইশ টাকা দেওয়া হয়। পড়ালেখা করে কী হবে। দিন শেষে টাকাই সব।
দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার একটি ইটভাটায় কাজ করে শিশু রিপন আহম্মেদ (ছদ্মনাম)। ইটভাটায় কাজ করা কষ্টকর হলেও পরিবারের জন্য তাকে এই পথ বেছে নিতে হয়েছে বলে জানায় রিপন। সে বলে, পরিবারের অভাব দূর করার জন্য আমাকে ইটভাটায় কাজ করতে হয়। এখান থেকে যা পাই সেটা পরিবারের একটু প্রয়োজন মেটে। কাজ না করলে সংসার চলে না আমাদের। তাই কষ্ট হলেও পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে ইটভাটায় কাজ করি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার সার্ভে ২০২২ এর প্রতিবেদন বলছে, মাজেদুল ও রিপনের মতো দেশে এখন শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৭ বছর। এ সংখ্যা ২০১৩ সালে ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ জন। ১০ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৮৬ হাজার ৫৫৮ জন। তবে শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জন। ২০১৩ সালের জরিপে ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন। এক্ষেত্রে শিশুশ্রম বেড়েছে ৭৭ হাজার ২০৩ জন।
ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০ মিলিয়নে। বিগত চার বছরের তুলনায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৮৪ লাখ। এই উদ্বেগজনিত হারে শিশুশ্রম বৃদ্ধির জন্য মূলত দরিদ্রতাকেই দায়ী মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। শিশুদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো নতুন নয়। আইন করেই বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে শিশুশ্রম। তারপরও কমছে না। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ শিশুদের ন্যূনতম বয়স ১৪ আর কিশোরদের বয়স ১৪-১৮ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ১৪ বছরের কম বয়সীদের কাজে নিয়োগ করা যাবে না। শিশুর অভিভাবক কাজ করানোর জন্য কারও সঙ্গে কোনো প্রকার চুক্তি করতে পারবেন না। তারপরও রোধ করা যাচ্ছে না শিশুশ্রম।
শিশু অপরাধীদের জন্য আলাদা আইন হলেও আদালত হয়নি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে শিশুদের বিচার হচ্ছে। যেখানে ধর্ষণ মামলার আসামিদের বিচার হয়। একই এজলাসে থাকায় ধর্ষণ মামলার আসামির বিচার তারা শোনে। এতে তাদের মানসিক ক্ষতি হয়।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান জাগো নিউজকে বলেন, ৯০ দশকে যত সংখ্যক শিশু রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো তা এখন অনেকটা কমে গেছে। এজন্য যথাযথ আইন প্রণয়নসহ বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা শিশুশ্রমে নিয়োজিত করে তাদের জন্য উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শিশুরা কেন শ্রমে যায় সেটাও দেখতে হবে। আইনে যে জরিমানা বা শাস্তির বিধান রয়েছে তা কম। আইনের সংশোধন করে শাস্তি আরও কঠোর করতে হবে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক দপ্তরের পরিচালক (সাধারণ) আব্দুল আজিজ মিয়া বলেন, সরকারের টার্গেট আছে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসন করা। আমরা শিশুশ্রম নিরসনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করি। অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে যখন মালিককে বলি শিশুদের কাজ থেকে অব্যাহতি দেন। তখন মালিক আমাদের বলেন, আমার এখান থেকে হয়তো তারা অব্যাহতি পেলো কিন্তু তারা অন্য জায়গায় তো ঠিকই কাজ করবে। শুধু তারা হাতবদল করে অন্য জায়গায় কাজ করবে এটা ছাড়া আর কিছু নয়।
এরপর আমরা যেসব প্রতিষ্ঠানে শিশুরা কাজ করে তাদের আলটিমেটাম দেই। শিশুশ্রম দণ্ডনীয় অপরাধ সেটা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বোঝাই। আমরা চেষ্টা করছি শিশুদের শ্রম থেকে বিরত রাখতে। এজন্য বিভিন্নভাবে শিশু ও তাদের অভিভাবককে সচেতন করছি। সাবেক বিশেষ পিপি ও আইনজ্ঞ অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মেদ বলেন, আমাদের দেশে তো অনেক আইনই আছে, বাস্তবায়ন কয়টা হয়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। আইনে তা আছে কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। শিশুশ্রম নিরোধ করতে হলে আইনের বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে। আইন আরও শক্তিশালী করতে হবে। আইনে জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ডের বিধান রাখতে হবে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার রিংকি বলেন, শিশু অপরাধীদের জন্য আলাদা আইন হলেও আদালত হয়নি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে শিশুদের বিচার হচ্ছে। যেখানে ধর্ষণ মামলার আসামিদের বিচার হয়। একই এজলাসে থাকায় ধর্ষণ মামলার আসামির বিচার তারা শোনে। এতে তাদের মানসিক ক্ষতি হয়। যারা শিশুদের খাটায় এবং শিশুদের অভিভাবকদের জন্যও শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এ আইন প্রয়োগ করতে হলে কোনো পক্ষ থেকে অভিযোগ আসতে হবে। যেহেতু দুপক্ষ লাভবান সেহেতু অভিযোগ করার কেউ নেই। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করতে দুপক্ষের সচেতনতা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, শিশুদের সুরক্ষার জন্য আইন আরও শক্তিশালী করতে হবে। শিশুর জন্য গঠন করতে হবে আলাদা এজলাস। শিশুর বিচারিক কার্যক্রমের সময় আদালতের পরিবেশকে শিশুবান্ধব করতে হবে। শিশুদের হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো যাবে না। শিশুরাই আমাদের দেশের সম্পদ। এ সম্পদ যেন অবহেলার শিকার হয়ে ঝরে না পরে সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু বলেন, যারা শিশুদের দিয়ে শ্রম করায় তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু এ আইনের প্রয়োগটা অনেক কম। আইন করার পরও যদি তা প্রয়োগ না করা হয় তাহলে আইনের কোনো মূল্যায়ন থাকে না। শাস্তি নিশ্চিত করা হলে শিশুশ্রম অনেকটা কমে আসবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল বলেন, বাংলাদেশের আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা হলেও গ্রাম ও শহরে সমানতালে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ সরকার নানানভাবে শিশুশ্রম বন্ধের চেষ্টা করলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাভাবিক সময়ই পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে শিশুরা শ্রমে যুক্ত হচ্ছে এবং যারা শিশুদের ব্যবহার করে তারাও অল্প খরচে তাদের কাজে খাটাতে পারছে। এজন্য কাজে লাগাচ্ছে। আমাদের দেশে তো অনেক আইনই আছে, বাস্তবায়ন কয়টা হয়। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। আইনে তা আছে কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। শিশুশ্রম নিরোধ করতে হলে আইনের বাস্তব প্রয়োগ করতে হবে।
‘যারা শিশুদের খাটায় এবং শিশুদের অভিভাবকদের জন্যও শাস্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এ আইন প্রয়োগ করতে হলে কোনো পক্ষ থেকে অভিযোগ আসতে হবে। যেহেতু দুপক্ষ লাভবান সেহেতু অভিযোগ করার কেউ নেই। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করতে দুপক্ষের সচেতনতা প্রয়োজন। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না বা তাকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। এ আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী, কোনো অভিভাবক শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি দিয়ে চুক্তি করতে পারবে না, করলেও সেটি অবৈধ চুক্তি বলে বিবেচিত হবে। যদি কোনো ব্যক্তি ৩৪ ধারা অমান্য করে শিশু বা কিশোরকে নিয়োগ দেয় বা অনুমতি দেয় ওই ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা এবং ৩৫ ধারার বিধান লঙ্ঘনে এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।