রাখাইনে তীব্র সংঘাত আবারও টেকনাফে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা

 রাখাইনে তীব্র সংঘাত আবারও টেকনাফে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা

প্রথম নিউজ, মিয়ানমার : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মিসহ বিদ্রোহী সংগঠনের লড়াই তীব্র হচ্ছে। এ ঘটনার জেরে প্রাণ বাঁচাতে কৌশলে কক্সবাজারের টেকনাফে ঢুকে পড়ছেন রোহিঙ্গারা।

শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) সারাদিন বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এতে আতঙ্কিত ছিলেন টেকনাফের বাসিন্দারাও।

সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপ এলাকায় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির ও আরও একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠনের সংঘাত চললেও সেটি এখন আরও তীব্র হয়েছে। গত শুক্রবার রাত থেকে মংডুর বিভিন্ন এলাকা থেকে থেমে থেমে মর্টারশেল, গ্রেনেড-বোমা বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায়। রাখাইনে চলমান সংঘাতের মধ্যে সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়লেও রোহিঙ্গাদের অনেকেই পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন প্রায় ১২ হাজার রোহিঙ্গা। সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার চেষ্টায় রয়েছেন আরও প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। ছয় মাস ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত চলছে। এখন সংঘাত সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছে।

টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর আরাফা বেগম বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনের ওপারে মর্টারশেল ও শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণে এপারের ঘরবাড়ি কাঁপছে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে মনে হয় বসতঘরের চালার ওপর বোমা এসে পড়ছে। রাতে বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে শিশুরা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এরইমধ্যে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশে ঢোকার জন্য রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছে বলেও খবর পেয়েছি।

রাখাইনের মংডু টাউনশিপের বিপরীতে (পশ্চিমে) চার কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদী পেরোলেই বাংলাদেশের টেকনাফ উপজেলা। টেকনাফের জনপ্রতিনিধিরা জানান, রাতের অন্ধকারে মংডু টাউনশিপের সুদাপাড়া, ফয়েজীপাড়া, সিকদারপাড়া ও নুরুল্লাপাড়া গ্রাম থেকে রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছেন। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছেন জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল দিয়ে। শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) রাতেই কেবল বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছেন চার শতাধিক রোহিঙ্গা। মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টায় রয়েছেন। রাখাইনের চলমান সংঘাতে সম্প্রতি তারা ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন।

দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা ঢুকছেন জানিয়ে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নজির আহমদ বলেন, গত কয়েক দিনে কেবল কেরনতলি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় তিনি শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করেছেন। বিজিবি এসব রোহিঙ্গাকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে।

শুক্রবার রাতে নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফের কেরনতলির এক বাসিন্দার বাড়িতে আশ্রয় নেন ১৫ শিশু ও ৯ নারীসহ চার পরিবারের ৩০ জন রোহিঙ্গা। তাদের বাড়ি মংডু টাউনশিপের পাশের গ্রাম সুদাপাড়ায়।

তাদের মাঝে দুজন জাহেদা বেগম (৩৫) ও নুর জাহান (৪০) বলেন, সাত-আট দিন ধরে মংডুতে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে উভয় পক্ষ শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমা, মর্টারশেলের পাশাপাশি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তাতে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছে।

তারা বলেন, যুদ্ধের মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা বসতি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে তাই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টায় রয়েছেন। তবে নৌকার অভাবে বাংলাদেশে ঢুকতে সমস্যা হচ্ছে।

দলের আরেক সদস্য সাব্বির আহমদ বলেন, নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফে ঢুকতে তাদের (রোহিঙ্গাদের) কাছ থেকে মাথাপিছু ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়েছেন দালালরা।

টেকনাফ বাস স্টেশনের করিম উল্লাহ নামে এক শ্রমিক বলেন, টেকনাফ বাস স্টেশন এলাকায় প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে মিয়ানমার থেকে পার হয়ে নতুন রোহিঙ্গারা গাড়িতে করে ক্যাম্পের দিকে চলে যাচ্ছেন।

টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মাইন উদ্দিন বলেন, কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে ঢুকে পড়েছে। তাদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা যেন ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে আশ্রয়শিবিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অনুপ্রবেশের সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাফ নদী থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।

কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে নতুন করে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছেন। তবে এ পর্যন্ত কত রোহিঙ্গা ঢুকেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, নতুন করে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ৮ হাজারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।