ম‌র্গে ম‌র্গে নি‌খোঁজদের সন্ধানে স্বজনরা

ঢাকার গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগার প্রায় একদিন হতে চললেও এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ওই ট্রেনে থাকা এলিনা ইয়াসমিনকে।

ম‌র্গে ম‌র্গে নি‌খোঁজদের সন্ধানে স্বজনরা

প্রথম নিউজ, ঢাকা: ‘আমার ছয় মাসের ভাগ্নের মাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার ভাগ্নেটা বার্নে ভর্তি। আপনারা আমার বোনটারে আইনা দেন। ওরে না পেলে বাচ্চাগুলার কি হবে।’ শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কথাগুলো বলছিলেন পাপুল। 

ঢাকার গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগার প্রায় একদিন হতে চললেও এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ওই ট্রেনে থাকা এলিনা ইয়াসমিনকে। এলিনা ফরিদপুর রাজবাড়ী থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। তার সঙ্গে সন্তানরাসহ পরিবারের আরও দুই সদস্য ছিল। 

এলিনার সন্তান সৈয়দ আফরান হোসেন বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছে। হাসপাতালে ভাগ্নেকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে বোনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন ভাই পাপুল।

পাপুল বলেন, আমার দুই বোন বাচ্চাদের নিয়ে ফরিদপুর সদর থেকে ঢাকায় আসছিল। তারা শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টায় পর ট্রেনে উঠে। দুলাভাই তাদের আনতে স্টেশনে যায় রাতে। এরমধ্যে এই ঘটনা ঘটে গেছে। ট্রেনে আমার দুই বোনসহ তাদের বাচ্চারা মোট ছয়জন ছিল। তাদের মধ্যে আমার ভাগ্নে হাসপাতালে ভর্তি। সবাই আছে। কিন্তু আমার বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পাপুল জানান, কোনো হসপিটাল আমার বোনের সন্ধান দিতে পারছে না। ঢাকা মেডিকেলে খোঁজ নিছি, এখানে খোঁজ নিচ্ছি কোথাও পাচ্ছি না তারপরে মুগদায় গেছি; কোথাও বোনকে পাচ্ছি না।  বার্নে ভর্তি ভাগ্নের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে মামা পাপুল জানান, ডাক্তার বলল, বড় কোনো সমস্যা নাই। শ্বাসনালীর সমস্যার কারণে পর্যবেক্ষণে রাখছে। কিছুটা সময় লাগবে। ভাগ্নে যখন মাকে চাইবে, কোথা থেকে এনে দেব? আপনারা আমার বোনকে খুঁজে দেন। 

পাপুলের দেওয়া তথ্য মতে, এলিনা ইয়াসমিন ঢাকার মিরপুরে থাকেন। শীতে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে বেড়াতে গেছেন। ৪০ বছর বয়সী এলিনা গৃহিনী। তিনি তিন সন্তানের মা। এলিনার ভাই ছাড়াও শেখ হাসিনা বার্নে সকাল নয়টা থেকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (দুপুর আড়াইটা) আগুন লাগা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে থাকা স্বজনদের খুঁজে না পাওয়া তিন পরিবারের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের।

চন্দ্রিমা চৌধুরী ফরিদপুর রাজবাড়ীর বাসিন্দা। ঢাকার গোপীবাগে আগুন লাগা বেনাপোল এক্সপ্রেসে ছিলেন চন্দ্রিমা। ট্রেনে আগুন লাগার আধ ঘণ্টা আগেও তার সঙ্গে কথা হয় পরিবারের। ট্রেনে আগুন লাগার পর থেকে এখন পর্যন্ত চন্দ্রিমার খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। তার মুঠোফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

চন্দ্রিমার চাচাতো ভাই অনিন্দ প্রামাণিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার চাচাতো বোন গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার পর রাজবাড়ী থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় আসছিল। ট্রেনে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয় পরিবারের। মাওয়া পার হওয়ার পর এমনকি ট্রেনে আগুন লাগার আধঘণ্টা আগেও বোনের সঙ্গে পরিবারের কথা হয়। ট্রেনে আগুন লাগার পর থেকে তার ফোন বন্ধ পাচ্ছি। এখন পর্যন্ত তার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। 

প্রামাণিক বলেন, গতকাল রাত থেকে ঢাকা মেডিকেল, মুগদা মেডিকেল, মিডফোর্ড, আনোয়ারা, ইসলামিয়া, গোপীবাগ সবগুলো হাসপাতালে খোঁজ নিছি, কিন্তু বোনকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে খোঁজ নিলাম, এখানে (শেখ হাসিনা) নিলাম। মর্গে খুঁজতেছি। কোনো জায়গায় পাচ্ছি না।

ওই ট্রেনে থাকা নাশাতা জেসমিনকে খুঁজে পাচ্ছে না তার পরিবার। নাতাশার ভাই খুরশিদ জানান, আমার বোন বন্ধুদের সঙ্গে ফরিদপুর গিয়েছিল। ঢাকার আসার জন্য ভাঙ্গা থেকে ট্রেনে উঠে। তার সঙ্গে আরও দুজন ছিল। বোনের সঙ্গে যে দুজন ছিল তারা আগুন লাগার পর ট্রেন থেকে বের হয়েছে। কিন্তু আমার বোনটা পারেনি। তাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। মর্গেও খুঁজলাম, কিন্তু পাচ্ছি না। 

বেনাপোল থেকে যাত্রী নিয়ে বেনাপোল এক্সপ্রেস কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছানোর আগে রাত ৯টার দিকে ট্রেনটিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ট্রেনটির চারটি কোচে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ট্রেনে আগুনে অন্তত চার জনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিখোঁজ ছেলের খোঁজে এসেছেন এক বাবা। বাবা আবদুল হক জানান, ফরিদপুর থেকে ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশে চড়েন আবু তালহা। রাতে ট্রেনে আগুন দেওয়ার পর তার মোবাইল বন্ধ। ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নেই, কিন্তু সেখানে যায়নি। আমি রাতে ঢাকায় চলে আসি। মুগদা, শেখ হাসিনা এবং ঢাকা মেডিকেলের মর্গে খুঁজছি, কিন্তু পাইনি। 

গোপীবাগে ট্রেনে আগুন লেগে আহত আটজন বর্তমানে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্নে ভর্তি রয়েছে। বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, তাদের কেউই ঝুঁকিমুক্ত নয়। তাদের শরীরের বাইরের অংশ দগ্ধ না হলেও ভেতরের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে এবং এসব রোগীরা ট্রমার মধ্যে আছে। আর এ ট্রমা থেকে বের হতে তাদের অনেক সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন সামন্ত লাল।

গত ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। আগুনে ট্রেনটির তিনটি কোচ পুরোপুরি পুড়ে যায়। পরে একটি কোচ থেকে মা ও শিশুসহ চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।