ভোটের ওপর আস্থা কমছে মানুষের

বুধবার অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ৬টি আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির অত্যন্ত নিম্নহার চলতি ধারার নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা আরও কমে যাওয়ার লক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভোট পড়েছে গড়ে মাত্র ২৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। দেশের নির্বাচনী ঐতিহ্যের নিরিখে এটা খুবই কম।

ভোটের ওপর আস্থা কমছে মানুষের

প্রথম নিউজ ডেস্ক: বুধবার অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ৬টি আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির অত্যন্ত নিম্নহার চলতি ধারার নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা আরও কমে যাওয়ার লক্ষণ বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের হিসেবে ভোট পড়েছে গড়ে মাত্র ২৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তবে একাধিক আসনে ভোট পড়ছে ১৬ শতাংশের কম। দেশের নির্বাচনী ঐতিহ্যের নিরিখে এটা খুবই কম।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ১১ মাস। এই সময়ের মধ্যে বড় পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আছে। বিশ্নেষকদের মতে, নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি ভোটারদের অনাগ্রহের কারণগুলো দূর হয়নি। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করছেন, ভোটের সার্বিক পরিবেশ কি এমন হতাশাজনকই থাকবে?
২০১৪ ও '১৮ সালে একতরফা নির্বাচন হয়েছিল। পরবর্তী স্থানীয় নির্বাচনগুলো গোলযোগপূর্ণ ও ভোটার খরাকবলিত। প্রায় এক বছর আগে দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের কাজ দিয়ে সাধারণ ভোটারদের আস্থা অর্জনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটারদের আস্থা ফেরানোর কথা ইসি মুখে বললেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। অথচ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য কমিশনার সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
বিএনপির পদত্যাগে শূন্য হওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩, বগুড়া-৪ ও ৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে গত বুধবার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হয়। এর আগে বহুল আলোচিত গাইবান্ধা-৫ আসনে ভোট পড়েছিল ৩৮ শতাংশ। ওই ভোটে ইভিএমের পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করে ইসি। ঢাকা থেকে সিসি ক্যামেরা দেখে প্রথম দফায় নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বুধবারের ভোটে আর্থিক খরচের কারণে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার থেকে বিরত থাকে এ প্রতিষ্ঠান।
এই উপনির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে বহুল আলোচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে- ১৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সর্বোচ্চ ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে- ৪৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এবার প্রার্থী নিখোঁজ হওয়া, হামলা, প্রতিপক্ষ প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেওয়া, ককটেল বিস্ম্ফোরণ, কেন্দ্রের গোপন কক্ষে 'ডাকাত' এবং ভোট গণনার শেষ মুহূর্তে ফল পাল্টে দেওয়ার মতো অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও প্রার্থীদের প্রার্থীতা প্রত্যাহারে বাধ্য করা, এমনকি প্রার্থী নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। যদিও ভোটের পরদিন নিখোঁজ প্রার্থীর খোঁজ পাওয়া গেছে। 
তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, প্রথম কারণ বিএনপির দখলে থাকা আসনগুলোর ভোটে তাদের অংশগ্রহণ ছিল না। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, উপনির্বাচনে সবসময়ই ভোটারদের উপস্থিতি কম থাকে। তৃতীয় কারণ তিনি চিহ্নিত করেছেন, চলমান সংসদের মেয়াদ কম হওয়ায় ভোটারদের আগ্রহ ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানগণমাধ্যমকে বলেন, ভোটারদের আস্থা অর্জন তো দূরের কথা, আগামী নির্বাচন ঘিরে সাধারণ ভোটারদের ভোট দেওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে কিনা- সেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, এই উপনির্বাচনকে একটা মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হলে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়- বর্তমান কমিশন নির্বাচনী মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। একচ্ছত্র কর্তৃত্বকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে ইসি কাজ করে চলছে- এমন মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, যে কোনো প্রার্থীর অভিযোগকে খুব দ্রুত ইসির পক্ষ থেকে নাকচ করা হচ্ছে অথবা উল্টো মন্তব্য করা হচ্ছে। এতেও কমিশনের দিক থেকে ভালো বার্তা জনগণের কাছে যাচ্ছে না। ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যার বাইরেও সংশ্নিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে পাওয়া তথ্যে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কয়েকটি আসনের ভোটের ফল যেন মানুষের আগেই জানা ছিল। তাই সাধারণ ভোটাররা কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী ছিলেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আব্দুস সাত্তার ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। আওয়ামী লীগের তিনজন বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নানা রকমের চাপ দিয়ে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিএনপির বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীর নিখোঁজ হওয়া ছিল এ উপনির্বাচনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বগুড়া জেলার দুটি আসন বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও সেখানে আওয়ামী লীগের ভোটাররা কেন্দ্রে উপস্থিত হননি। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্বাচন বর্জনে থাকা বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মী কেন্দ্রে ভোটারদের যেতে নিরুৎসাহিত করেছেন- এটা ঠিক। এর পাশাপাশি বগুড়া-৬ সদর আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর কৌশলের কারণেও ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে। কারণ নৌকার প্রার্থীর আশঙ্কা ছিল, বিএনপি অধ্যুষিত এই এলাকায় ভোটার উপস্থিতি বেড়ে গেলে নৌকাবিরোধী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সুবিধা পাবেন। আর বগুড়া-৪ আসনটি শরিক দল জাসদকে ছেড়ে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিতরা ভোটের বিষয়ে নিষ্ফ্ক্রিয় ছিলেন। এ আসনে ফল পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন একজন প্রার্থী। 
বগুড়া-৬ আসনের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুটি আসনেও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছিল। অভিযোগ রয়েছে, ভোটার উপস্থিতি কম করার লক্ষ্য নিয়েই আতঙ্কের অবস্থা সৃষ্টি করা হয়। স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়নি। ভোটের আগের রাতে কয়েকটি কেন্দ্রের কাছে ককটেলের বিস্ম্ফোরণ হয়। অনেক কেন্দ্র থেকে ভোট গ্রহণ শুরুর পরই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ কমে যায়। এ জেলার দুটি আসনের একটিতে ৩৪ শতাংশ, আরেকটিতে ২৯ শতাংশ ভোট পড়ে।
ঠাকুরগাঁও-৩ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত হলেও এ আসনটি এবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টিকে। এতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী অংশগুলো নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মধ্যে ভোটের আগে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে- এখন যিনি বিজয়ী হবেন, তিনিই এক বছর পরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। ফলে দুর্বল সাংগঠনিক ভিত্তি নিয়ে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে ব্যর্থ হন ওয়ার্কার্স পার্টির মনোনীত প্রার্থী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন বিশ্নেষক ও ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিচালক আব্দুল আলীম বলেন, দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে কিছু অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ভোটের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। এ কাজ ইসির একার পক্ষে সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক উদ্যোগ।
তিনি বলেন, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। বড় দলের কেউ নির্বাচন বর্জন করলেও ভোটার উপস্থিতি কমে যাবে। ভোটার কম হলে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুর, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট ও খুলনা- এই পাঁচ সিটির নির্বাচনের মাধ্যমে ইসি জনগণের আস্থা অর্জনের সুযোগ নিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, উপনির্বাচনে আমাদের মতো দেশে সব সময়ই সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম থাকে। তার পরও বিএনপি নেতৃত্বাধীন একটি বড় রাজনৈতিক মোর্চা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ভোটার উপস্থিতি কম হওয়াই স্ব্বাভাবিক।
তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে যখন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তখন ভোটার উপস্থিতি নিয়ে ইসিকে ভাবতে হবে না। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের 'গোপন কক্ষে ডাকাত', প্রার্থী নিখোঁজ ও ককটেল বিস্ম্ফোরণের মতো ঘটনা নির্বাচনী সংস্কৃতি থেকে দূর করতে ইসিকে আরও সক্রিয় হতে হবে। আরেফিন সিদ্দিক ইভিএম না হলে ইসিকে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে পরামর্শ দিয়ে বলেন, প্রযুক্তির এই যুগে আর্থিক বা অন্য কোনো সীমাবদ্ধতার কথা এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে না।
ইসি-সংশ্নিষ্টরা জানান, বর্তমান কমিশনের মেয়াদে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ফরিদপুর-২ আসনে ভোট পড়েছে ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। বগুড়া-৪ আসনে ভোট পড়েছে ২৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। বগুড়া-৬ আসনে ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর আগে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। সেটা ছিল মাত্র ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোটে প্রার্থী নিখোঁজ হওয়ার বিষয়কে 'ইলেকশন মেকানিজম' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন নির্বাচন কমিশনার রাশিদা সুলতানা। তিনি বলেন, 'যারা মেকানিজম করে তারা কিন্তু ইসির সঙ্গে আলোচনা করে না। এটা আসলে একট কৌশল।'
জাতীয় নির্বাচনে যদি একই কৌশল হয় তখন ইসির ভূমিকা কী হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'কৌশল দেখা ইলেকশন কমিশনের কাজ না। ৩৯টি দল কী মেকানিজম করছে, তা কি কমিশন খুঁজে খুঁজে বের করবে? এটা আদৌ সম্ভব না। এটা যার যার রাজনৈতিক কৌশল।'
ছয় আসনের উপনির্বাচনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, দলছুট নেতাকে দলে ভেড়ানো কোনো ভালো উদাহরণ হতে পারে না। এটা আগামী নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত। নির্বাচন ব্যবস্থায় দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসছে বলে মনে করেন না তিনি। তাঁর মতে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়- এটাই বারবার প্রমাণ হচ্ছে। কিন্তু ইসি তা প্রকাশ্যে স্বীকার না করে তার পক্ষে সাফাই গেয়ে আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে আরও বড় সংশয় তৈরি করছে। এমন পরিস্থিতিতে একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে হাঁটছে ইসি। সমস্যা রাজনৈতিক হলেও তার সমাধানে উদ্যোগ নিতে পারে ইসি। কিন্তু তারা সেটি না করে নির্বাচনী অনিয়মকে বৈধতা দিচ্ছে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: