রূপপুরের কিস্তি শোধের উপায় খুঁজতে রাশিয়া যাবেন কর্মকর্তারা

রাশিয়া তাদের মুদ্রা রুবলে কিস্তির পাওনা পরিশোধের পরামর্শ দিলেও বাংলাদেশ তাতে রাজী নয়। কিন্তু বাংলাদেশ এ অর্থ শোধ করতে আগ্রহী।

রূপপুরের কিস্তি শোধের উপায় খুঁজতে রাশিয়া যাবেন কর্মকর্তারা
রূপপুরের কিস্তি শোধের উপায় খুঁজতে রাশিয়া যাবেন কর্মকর্তারা

প্রথম নিউজ, ডেস্ক: বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধের উপায় খুঁজতে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দলকে রাশিয়ায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে। রাশিয়া ঋণের এই কিস্তি শোধের জন্য বারবার বাংলাদেশকে চিঠি দিলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে দেয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে আগে যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হতো, এখন সেভাবে কিস্তির অর্থ শোধ দিতে পারছে না বাংলাদেশ। আবার রাশিয়া তাদের মুদ্রা রুবলে কিস্তির পাওনা পরিশোধের পরামর্শ দিলেও বাংলাদেশ তাতে রাজী নয়। কিন্তু বাংলাদেশ এ অর্থ শোধ করতে আগ্রহী।

এই পরিস্থিতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন কাজের বিল পরিশোধ নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। যদিও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বিবিসিকে বলছেন যে প্রকল্পের কাজে এখনো কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। এটি যথাযথভাবে এগিয়ে চলছে। ওসমান অবশ্য বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। যদিও তিনি নিজেই ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন। রূপপুর প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ, যার কিস্তি শোধ শুরু হওয়ার কথা ২০২৭ সালে।

তবে ডলার সঙ্কটের জের ধরেও প্রকল্পটির কাজ ঠিক সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে আগেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো সভায় মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবারের বৈঠকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কীভাবে রাশিয়ার ঋণের সুদের কিস্তি শোধ করা হবে। এছাড়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে কিছু দেশ রূপপুরের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে না, যদিও আগে তারা এজন্য চুক্তি করেছিল।

ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাও তৈরি হচ্ছে। এ কারণে বিকল্প কোন উৎস থেকে এসব যন্ত্রপাতি আনা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে ওই বৈঠকে। আরেকটি বিষয় হলো, রাশিয়ার ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কবে প্রত্যাহার হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে রাশিয়ার সহযোগিতা নিয়ে রূপপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ হচ্ছে না।

এ কারণে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হবে এবং আর্থিক চুক্তি সংশোধন করা দরকার বলে মনে করে বাংলাদেশ। এ জন্য রাশিয়াকে চিঠিও দেয়া হয়েছে। দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রথম দফায় ২০১৩ সালে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ ও রাশিয়া। এ ঋণেরই সুদ পরিশোধ শুরু হয়েছে ২০১৮ সাল থেকে। আর মূল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ঋণচুক্তি হয়েছিল ২০১৬ সালে। সব মিলিয়ে যে এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ, তার কিস্তি শুরু হবে ২০২৭ সালে।

কিন্তু এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকল্প নির্ধারিত ২০২৫ সালে শেষ না হলে ২০২৭ সাল থেকে কিস্তি শোধ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে মনে করে বাংলাদেশ চায়, আর্থিক চুক্তি সংশোধন করে আরো সময় দেয়া হোক। মূলত এ বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল রাশিয়া সফরে যাবে। সেখানে গিয়ে তারা দেখবে যে অন্য কোনো ব্যাংক আছে কি-না, যা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই এবং যার মাধ্যমে বাংলাদেশ কিস্তির অর্থ পাঠাতে পারে।

এছাড়া ঋণের অব্যবহৃত অর্থের কমিটমেন্ট ফিও মওকুফ চায় বাংলাদেশ। কারণ, বৈশ্বিক কারণেই সময় মতো ওই অর্থ ব্যবহার করা যায়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ায় গিয়ে প্রতিনিধি দলটি এসব নিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করবেন, যাতে সমস্যাগুলো সমাধানের একটি উপায় খুঁজে বের করা যায় এবং প্রকল্পের কাজ যেন চালু রাখা যায়।

রূপপুর প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন

বাংলাদেশে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে ২০১৭ সালের নভেম্বরে দেশটির প্রথম পারমাণবিককেন্দ্রের মূল নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের একক বৃহত্তম প্রকল্প এটি। পাবনায় পদ্মা নদীর পাড়ে রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন নেতৃত্ব দিচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন হবে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

১৯৬১ : পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ।

১৯৬২-১৯৬৮ : পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদীর তীরবর্তী রূপপুরকে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থান হিসাবে নির্বাচন এবং প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর ও আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ।

১৯৬৯-১৯৭০ : ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়।

১৯৭৭-১৯৮৬ : একনেক কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (১২৫ মেগাওয়াট) নির্মাণ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন। কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বাতিল হয়ে যায়।

১৯৮৭-১৯৮৮ : জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দু’টি কোম্পানির দ্বিতীয়বার ফিজিবিলিটি স্টাডির আলোকে ৩০০-৫০০ মেগা-ওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ।

১৯৯৭-২০০০ : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া কর্তৃক ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ।

২০০৯ : পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যাবলী ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও রাশান ফেডারেশনের স্টেট এ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন (রোসাটোম)-এর মধ্যে 'পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার'-বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর।

২০১০ : বাংলাদেশ সরকার এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষর। নভেম্বরে জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ।

২০১১ : বাংলাদেশ এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন-সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর।

২০১৩ : অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন।

২০১৬ : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে স্টেট ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষর।

সূত্র : বিবিসি

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: