বিশ্ব এখন ‘চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে’ যাচ্ছে: ড. ইউনূস

বিশ্ব এখন ‘চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে’ যাচ্ছে: ড. ইউনূস
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বিশ্ব এখন ‘চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে’ যাচ্ছে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এই অস্থির সময় বিশ্বব্যাপী আস্থার সংকট তৈরি করছে। বৃহস্পতিবার (২৯ মে) জাপানের টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে ‘৩০তম নিক্কেই ফোরাম: ফিউচার অব এশিয়া’র উদ্বোধনী অধিবেশনে মূল প্রবন্ধে এ কথা বলেন নোবেলজয়ী ইউনূস। তিনি বলেন, “দেশগুলোর মধ্যে, সমাজে সমাজে, এমনকি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও বিশ্বাস কমে যাচ্ছে।”
‘এশিয়ান চ্যালেঞ্জেস ইন আ টার্বুলেন্ট ওয়ার্ল্ড‘ শীর্ষক এই প্রবন্ধে ইউনূস বলেন, “আমরা এমন এক সময় অতিক্রম করছি, যেখানে অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে। শান্তি হয়ে উঠছে ভঙ্গুর, উত্তেজনা বাড়ছে; আর সহযোগিতার নিশ্চয়তাও সব সময় মিলছে না।” তিনি বলেন, এশিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে সংঘাতের সূত্রপাত হচ্ছে। ইউক্রেইন, গাজা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও মানবসৃষ্ট সংঘাত হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করে দিচ্ছে। “আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প একটি গভীর মানবিক সংকটকে আরও গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “সম্প্রতি আমাদের দুই প্রতিবেশী (ভারত ও পাকিস্তান) একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়ায়। দুঃখজনকভাবে, আমরা এখনো যুদ্ধবাজিতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছি, অথচ লাখো মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, ন্যূনতম চাহিদা পূরণেও তারা হিমশিম খাচ্ছে।” তবে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ায় দুই দেশের নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ দেন ইউনূস; দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহাবস্থান বজায় থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, সে কথা মনে করিয়ে দেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, প্রযুক্তির উন্নয়ন যেমন নতুন সম্ভাবনা জাগিয়েছে, তেমনি তা নতুন নতুন নৈতিক সংকটও তৈরি করছে। তার ভাষায়, বাণিজ্য বাধা বাড়তে থাকায় মুক্তবাজার অর্থনীতির ভিত্তিই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সমাজের ভেতরেই অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে। ইউনূস বলেন, “সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক বিভাজন, জনঅসন্তোষ ও অস্থিরতা দেখেছি, যার পরিণতিতে ক্ষমতা বদল হয়েছে।”
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরে ইউনূস বলেন, গত বছর ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তন এসেছে, যার ধারাবাহিকতায় তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। “আমাদের জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য; ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে গণতন্ত্রের পথে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করছি।
“আমরা বিশ্বাস করি, এটাই আমাদের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ, নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সময় এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত।” বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও শান্তি স্থাপন মিশনে অংশ নিয়ে বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তায় অবদান রাখছে, সে কথাও তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ দশ লখের বেশি রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে, যারা মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।
এশিয়া যে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষের আবাসভূমি, সে কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, এই মহাদেশ এখন অনিশ্চয়তার কেন্দ্রবিন্দু। তবে একইসঙ্গে এটি সম্ভাবনারও কেন্দ্র। “আমাদের সম্মিলিত শক্তি রয়েছে, আমাদের সামনে রয়েছে একটি ভিন্ন পথ দেখানোর সুযোগ, সেটা শান্তির পথ, সংলাপের পথ, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথ। শুধু সংখায় জিডিপি বাড়ানো নয়, বরং মানুষের কল্যাণ, বিশ্বাস ও আশার প্রবৃদ্ধির কথা ভাবতে হবে।”
তিনি বলেন, “এসব চ্যালেঞ্জের সামনে আমরা অসহায় নই। বরং ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আজকের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে, আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কেমন পৃথিবী রেখে যাব।” “তাই শুধু সমস্যা নিয়ে আলোচনা নয়, বরং এর সমাধান গড়ে তোলার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”
ইউনূস এমন সমাধানের কথা বলেন, যা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য এবং মানবিক মূল্যবোধভিত্তিক। নিজের চিন্তার কথা জানাতে গিয়ে ইউনূস বলেন, “আমি প্রায়ই বলি, অর্থ উপার্জন সুখের। কিন্তু মানুষকে সুখী করা আরও বড় সুখ। “ব্যক্তি মুনাফা থেকে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে সম্মিলিত কল্যাণে মন দিতে হবে, স্বল্পমেয়াদি লাভের বদলে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভাবতে হবে।”
বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইউনূস নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “আমি যখন গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্র নারীদের ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া শুরু করি, তখন থেকেই শিখেছি—মানুষ কষ্টভোগের জন্য জন্মায়নি। মানুষের মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কেবল সঠিক সুযোগটা দিতে হবে।”
নিজের ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বের কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন—শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ—এটি কোনো কল্পনা নয়, বরং এটি এমন এক লক্ষ্য, যার দিকে সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যক্তি––সবাই একযোগে এগিয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, “আমাদের দরকার নতুন ধরনের একটি অর্থনীতি—যেটি কেবল প্রতিযোগিতার নয়, সহানুভূতির ওপর গড়ে উঠবে। কেবল ভোগ নয়, বরং যত্ন ও দায়িত্ববোধের ওপর ভিত্তি করবে বেড়ে উঠবে। এখানেই সামাজিক ব্যবসার ভূমিকা, যে ব্যবসা কেবল লাভ করবে না, সমস্যার সমাধান করবে।”
নিক্কেই ফোরামকে ‘একটি আশার প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে বর্ণনা করেন ইউনূস। তিনি বলেন, নিক্কেই সেই জায়গাটা গড়ে তুলেছে, যেখানে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান বেরিয়ে আসে। আর আস্থা এখানে কেবল একটি শব্দ নয়, বরং একটি লক্ষ্য, যা একসঙ্গে অর্জন করতে হয়। “এশিয়ার ভবিষ্যৎ কেবল অর্থনীতি কিংবা ভূরাজনীতির বিষয় নয়, এটি মানুষ, চিন্তা ও সাহসের বিষয়। চলুন, আশেপাশের এই অস্থিরতা দেখে ভয় না পেয়ে আমরা এটাকে র্বিনির্মাণের, একত্রে জেগে ওঠার আহ্বান হিসেবে দেখি।
“ভয় নয়, সম্ভাবনা হোক আমাদের পথপ্রদর্শক। ক্ষমতা নয়, উদ্দেশ্য হোক আমাদের চালিকাশক্তি। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ কল্পনা করার সাহস আমাদের হোক, আসুন আমরা একে অপরের ওপর বিশ্বাস রাখি। আসুন পরস্পরকে সহযোগিতা করি; সেটা কেবল দরকার বলে নয়, আন্তরিকভাবেই সেটা যেন আমরা করি।” তিনি বলেন, “এশিয়ার ভবিষ্যৎ এখনো লেখা হয়নি। আসুন, আমরা একসঙ্গে সেটা লিখি।”
বাংলাদেশ ও জাপান একসঙ্গে এশিয়ার ভবিষ্যৎ, এমনকি বিশ্বের ভবিষ্যৎও নতুন করে রচনা করতে পারে বলে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা।