বিদ্যুৎখাতের চলমান সংকট রাজনৈতিক, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয় না: ওয়েবিনারে বক্তারা

তারা বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ও চাহিদা নিয়ে যে তথ্য দেয়া হয়, সেগুলো বিভ্রান্তিমূলক। বাস্তবে সরকারি হিসাবের চেয়ে দেশে উৎপাদন কম এবং চাহিদা বেশি।

বিদ্যুৎখাতের চলমান সংকট রাজনৈতিক, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা হয় না: ওয়েবিনারে বক্তারা

প্রথম নিউজ, ঢাকা: দেশের চলমান বিদ্যুৎ সংকট রাজনৈতিক। এই খাতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ না করে রাজনৈতিকভাবে সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কিছু মানুষকে সুবিধা দেয়ার জন্য পক্ষপাতিত্ব করা হয়। কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের 'চলমান বিদ্যুৎ সংকট: কেন তৈরি হলো? উত্তরণ কীভাবে?' শীর্ষক ওয়েবিনারে শনিবার বক্তারা এসব কথা বলেন।

তারা বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ও চাহিদা নিয়ে যে তথ্য দেয়া হয়, সেগুলো বিভ্রান্তিমূলক। বাস্তবে সরকারি হিসাবের চেয়ে দেশে উৎপাদন কম এবং চাহিদা বেশি। ওয়েবিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক গবেষক ও লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তার প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের মূল সমস্যা প্রাথমিক জ্বালানির জোগান পরিকল্পনাকে সাস্টেইনেবল করতে ব্যর্থ হওয়া। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফুয়েল প্ল্যানিং না থাকা, অফশর ও অনশোরে গ্যাস কূপ খননে গড়িমসি, সর্বোপরি সবুজ বিদ্যুতে বিনিয়োগ এবং সবুজ বিদ্যুৎ বান্ধব নীতি কৌশলের অভাব।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৭ হাজার মেগাওয়াটের যে কথা বলা, সেগুলো রাজনৈতিক বক্তব্য। আমরা সত্যিকার অর্থে উৎপাদন করতে পারি ১৮ থেকে ১৯ হাজার মেগাওয়াট এবং চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো। তিনি বলেন, বিদ্যুতের কারিগরি বিষয়গুলো নিয়ে রাজনীতি করা হয়েছে, যেগুলো ঠিক হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সেভাবে গ্রহণ না করে রাজনৈতিকভাবে সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে কিছু মানুষকে সুবিধা দেয়ার জন্য পক্ষপাতিত্ব করা হয়। তিনি আরও বলেন, যেসব প্ল্যান্ট বসিয়ে রাখা হচ্ছে সেগুলো খুঁজে বের করতে হবে। আর যেসব ডিজেলচালিত প্ল্যান্ট থেকে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় আর অধিকাংশ সময় অকার্যকরভাবে থাকে, সেগুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। এই মন্ত্রণালয়ে যারা কাজ করেন, তারা অধিকাংশ নন-টেকনিক্যাল লোক। তারা জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাতে বিশেষজ্ঞদের সিদ্ধান্তগুলো পরিবর্তন করে দিয়ে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেন। ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। যে টেন্ডার হয় সেগুলো ওপেন করে দিতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া এই সংকট দূর করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
শেয়ার বিজের নির্বাহী সম্পাদক মো. ইসমাইল আলী বলেন, লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে যত মেগাওয়াটের হিসাব দেয়া হয়, বাস্তবে তা আরও বেশি। কারণ আমাদের ডিমান্ড ফোরকাস্টের সঠিক হিসাব দেখানো হয় না। বিদ্যুতের চাহিদা নিয়ে ২০১৬ সালে পল্লীবিদ্যুৎ যে জরিপ করেছিল, সেটিই এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে প্রতিবছর তার সঙ্গে ৫ শতাংশ করে যোগ করা হয়। কাজেই প্রকৃত চাহিদা কত, তা আমরা জানতে পারি না। তিনি বলেন, এই খাতে বড় ধরনের ঘাটতির কারণে পিডিবি কয়লার বিল দিতে পারছে না। সরকার কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেবে, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তগুলো পিডিবি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়। সমস্যার পেছনে মূল কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতা।

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, একটি বিশেষ আইনের ক্ষমতাবলে বিদ্যুৎখাতের সব চুক্তিকে বৈধ করা হয়। ফলে এ খাতের দুর্নীতি নিয়ে তেমন প্রশ্ন করা যায় না। তবে এই বিশেষ আইনের মাধ্যমে কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে মূলত ডলার সংকটের কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখতে পাই আমরা যাদের কাছ থেকে ডলার আয় করি, তাদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক করছি, আর যাদের কাছে ডলার ব্যয় করি তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখছি। সংকট মূলত রাজনৈতিক। তিনি বলেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্নখাতে আমাদের যে ডেটা দেয়া হয়, তা সঠিক নয়। এখানে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেয়া হয়। অনেক সময় ডেটা বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেয়া হয়। যে সমস্যা আছে সেগুলো আমরা সমাধান করতে চাইনি। বিশেষ কিছু মানুষকে সুবিধা দিতেই এসব করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো আলী রীয়াজ বলেন, বিদ্যুৎখাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সমন্বিত পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা অনুপস্থিত। পরিকল্পনাগুলো অংশগ্রহণমূলক হয় না। বিদ্যুৎখাতে যে সংকট, তা কিন্তু হঠাৎ করে আসেনি। কিন্তু তা সমাধানে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, এই খাতের সংকট নির্ভর করছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। আমাদের সমাধান বাইরে থেকে এসে কেউ দেবে না। আমাদের সমাধানের সক্ষমতা আছে। আমাদের বিশেষজ্ঞ লোক আছেন। সেজন্য অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।