পারস্পরিক শুল্ক, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা অর্ডার স্থগিত শুরু করেছেন

প্রথম নিউজ, অনলাইন: যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক ক্রেতারা অর্ডার স্থগিত করা শুরু করেছেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় এ উদ্যোগ নিচ্ছে তারা। ইতোমধ্যে বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট বাংলাদেশে পোশাকের কিছু অর্ডার পিছিয়ে দিয়েছে, আর কিছু অর্ডার স্থগিত করেছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্স সংবাদ প্রকাশ করায় বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার স্থগিতের আশঙ্কা করছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। ১ আগস্ট থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে অর্ডার কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন গার্মেন্টস মালিকরা। কারণ এই অতিরিক্ত খরচ তারা বহন করতে পারবেন না।
প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, শুল্কের কারণে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ওয়ালমার্ট প্রায় ১০ লাখ সাঁতারের পোশাকের একটি অর্ডার বৃহস্পতিবার স্থগিত করেছে। ক্ল্যাসিক ফ্যাশন অর্ডার স্থগিত রাখার জন্য ই-মেইল করেছে। অবশ্য ক্ল্যাসিক ফ্যাশনের সহকারী মার্চেন্ডাইজিং ম্যানেজার ফারুক সৈকত প্যাট্রিয়ট ইকো অ্যাপারেল লিমিটেডের অর্ডার স্থগিতের ব্যাপারে রয়টার্সকে বলেন, অর্ডার স্থগিতের সিদ্ধান্ত ওয়ালমার্ট নয় ক্ল্যাসিক ফ্যাশন নিজেই নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বছরে এক হাজার কোটি টাকার বেশি রপ্তানি করে স্প্যারো গার্মেন্টস। এ গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বর্ধিত শুল্ক বহাল থাকলে ভবিষ্যতে অনেক অর্ডার বাতিল হবে। সেটা প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। কেননা আমেরিকায় মোট রপ্তানির ২৫ ভাগ পণ্য রপ্তানি হয় সাধারণ আমদানিকারক ও বায়িং হাউজের মাধ্যমে। এ ধরনের আমদানিকারকদের স্থানীয় ভোক্তা ও সরবরাহকারীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে না। তাই বর্ধিত শুল্ক সমন্বয় করতে না পারলে অর্ডার বাতিল করবেই। অন্যদিকে স্থানীয় ভোক্তা ও পোশাক সরবরাহকারীদের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকায় হয়তো বড় ব্র্যান্ডগুলো তাৎক্ষণিকভাবে অর্ডার বাতিল করবে না। কিন্তু তারাও একটা সময় সেই অর্ডারগুলো সরিয়ে নেবে। কারণ ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়, সেটা যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডরাও জানে। ইতোমধ্যে জর্ডান, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, মিসর ও সাউথ আফ্রিকার মতো গার্মেন্টস খাতে বিনিয়োগে সরব হয়ে উঠেছে এবং এর পেছনে চীনা বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন। সামগ্রিকভাবে পারস্পরিক শুল্ক প্রত্যাহার না হলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে সামনে ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছে।
তিনি আরও বলেন, পোশাক রপ্তানিকারক ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক হিসাবে নিজেকে অসহায় ও হতাশ অনুভব করছি। যেসব প্রতিনিধি বাংলাদেশ পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন, তারা নিজেরাও হয়তো জানেন না ট্রাম্প প্রশাসন কী প্রত্যাশা করছে তাদের কাছে। বাংলাদেশের এখন প্রতীকী বা ধীরে ধীরে কূটনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার সময় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কের বোঝা এড়াতে এবং আমাদের প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত রাখতে হলে জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও কৃষিভিত্তিক একটি সাহসী, কৌশলগত চুক্তি উপস্থাপন করতে হবে-যেটি রাজনৈতিকভাবে দৃষ্টিগোচর হবে এবং যেখানে পারস্পরিক স্বার্থও সুনির্দিষ্টভাবে বিবেচনায় নেওয়া হবে। বাংলাদেশকে এখনই আলোচনার গতি বাড়াতেই হবে। এই গতি না পেলে আমরা আমাদের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হারাব। এখন দরকার সাহসী কৌশল ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত। অপেক্ষা বা দ্বিধার সময় পেরিয়ে গেছে।
এদিকে শনিবার বিকালে উত্তরায় বিজিএমইএ কার্যালয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নির্বাহী কমিটির সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান (বাবু)। বৈঠকে ডিআরইউ সভাপতি আবু সালেহ আকন ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল আলোচনায় অংশ নেন। সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পালটা শুল্ক নিয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের চেষ্টা করেছিলাম, তবে তা সম্ভব হয়নি। পরে অন্য চার উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেছি। বৈঠকের মাঝখানে বাণিজ্য উপদেষ্টা ফোনে জানতে চেয়েছেন, যদি ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনের শর্ত চাপানো হয়, তাহলে ব্যবসা চালানো সম্ভব হবে কিনা? ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের শর্ত এখনো চূড়ান্ত নয়। এটিসহ আরও কিছু বিষয় আলোচনার মধ্যে রয়েছে। এ ধরনের আলোচনায় ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করা উচিত ছিল, কারণ এটি তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
বিজিএমইএর সভাপতি অভিযোগ করেন, সরকারের একজন প্রতিনিধি সময়মতো সঠিকভাবে আলোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার ফলে দুই মাস সময় নষ্ট হয়েছে। পরে আরেকজন প্রতিনিধি আলোচনায় যুক্ত হন। সরকার যদি সত্যিই এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চায়, তাহলে সবচেয়ে বড় অংশীজন ব্যবসায়ীদের উপেক্ষা কীভাবে করে? এখন সরকার অজুহাত দেখাচ্ছে তথাকথিত একটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্টের (অপ্রকাশযোগ্য চুক্তি)। আবার সরকার যখন দাবি করছে মার্কিন পণ্যের শুল্ক কমানোর, তখন বাজেটে তুলা আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপ করেছে। এই বার্তা যদি মার্কিন প্রশাসনের কাছে পৌঁছায়, তখন তারা বলতে পারে, বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলে তুলার ওপর অগ্রিম আয়কর আরোপ স্ববিরোধী অবস্থান কিনা?
অন্যদিকে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম শনিবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত বাজার প্রবেশাধিকার দাবি করেছে, বিশেষ করে যেসব পোশাক যুক্তরাষ্ট্রের তুলা দিয়ে তৈরি হয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের তুলার আমদানি বাড়বে এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। বাণিজ্য উপদেষ্টার কথা উল্লেখ করে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। তবে কিছু বিষয় মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে আরও আলোচনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, যদি ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের শর্ত আরোপ করা হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ওভেন পোশাক রপ্তানি মারাÍকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে নিটওয়্যার ও ডেনিম খাতের ওপর এর প্রভাব পড়বে না।