পাঁচ মাসে বাস্তবায়ন করতে হবে ৬ শর্ত
সংস্থাটি আগামী ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ১৯টি শর্ত বাস্তবায়ন করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। কোন শর্তটি কোন সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে তাও সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম নিউজ ডেস্ক: আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কার চায়। এ জন্য সংস্থাটি আগামী ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ১৯টি শর্ত বাস্তবায়ন করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। কোন শর্তটি কোন সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে তাও সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আগামী জুনের মধ্যে অর্থাৎ পাঁচ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে ছয়টি শর্ত। আর চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে দুটি, ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে তিনটি, ডিসেম্বরের মধ্যে একটি শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে একটি এবং ডিসেম্বরের মধ্যে ছয়টি শর্ত মানতে হবে।
সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় আইএমএফ বাংলাদেশকে যেসব শর্ত দিয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করা হবে প্রতি কিস্তির ঋণ ছাড়ের আগে। শর্ত বাস্তবায়নের সন্তোষজনক অগ্রগতি হলেই কেবল ঋণের কিস্তি ছাড় করা হবে। এ কারণে ছয়টি স্তরে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়টি পর্যালোচনা করবে আইএমএফ। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার অনেক দিন ধরেই চাওয়া হচ্ছে। এটি হলে এ খাতের সার্বিক অবস্থার চিত্র যেমন প্রকাশিত হবে, তেমনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। এতদিন সরকার তা করেনি। এখন আইএমএফের ঋণ নিতে গিয়ে চাপে পড়ে সংস্কার করতে বাধ্য হচ্ছে। এটি ইতিবাচক। এতে আর্থিক খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ব্যাংক খাত সংস্কারের আওতায় আগে পরিচালকদের সংখ্যা নয়জনে সীমিত করা হয়ছিল। একই পরিবারের একাধিক সদস্য থাকার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। পরপর দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবে না। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করেছিল। পরে সরকার তা শিথিল করে দেয়। এতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেয়।
এখন আইএমএফের চাপে সংস্কার হলে এটি ভালো হবে। তবে আইএমএফের কিছু শর্ত বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। যেমন সঞ্চয়পত্র এক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসাবে কাজ করে। এটি যাতে প্রকৃত পক্ষে স্বল্প আয়ের মানুষ পায় সেটি নিশ্চিত করতে পারে সরকার। কিন্তু আইএমএফ এর সুদের হার কমাতে বলেছে। ঋণের সুদের হারের সীমা তুলে দিলে তা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাবে। এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা দরকার।
আইএমএফের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, আগামী পাঁচ মাসে যে ছয়টি শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঋণ পুনঃতফসিল ও খেলাপির তথ্য বার্ষিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে প্রকাশ করা। বর্তমানে মোট খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু ব্যাংকের নাম ধরে তা প্রকাশ করা হয় না। খেলাপি ঋণ নবায়নের তথ্য প্রকাশ করা হয় না। এসব তথ্য প্রকাশ করা হলে পুনঃতফসিলের কারণে কি পরিমাণ খেলাপি ঋণ কমল সে তথ্য জানা যাবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের মাত্রাও বোঝা যাবে।
ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি করতে পাইলট ভিত্তিতে সুপারভিশন ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা নিতে বলেছে আইএমএফ। এটি এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক করছে। কিন্তু তা কঠোরভাবে করে না এবং সুপারভিশনের আওতায় ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এখন সংস্থাটির শর্তে এটি কঠোরভাবে প্রয়োগ করলে আর্থিক খাতে ঝুঁকির মাত্রা কমানো ও জাল জালিয়াতি শনাক্তের সুযোগ তৈরি হবে।
সংস্থাটি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য কোম্পানি আইন ও নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ফাইন্যান্স কোম্পানি আইনের সংশোধনী সংসদে উপস্থাপন করার শর্ত দিয়েছে। একই সঙ্গে আইনকে আন্তর্জাতিক মানের করতে বলেছে। ফলে ব্যাংকে পরিচালকের সংখ্যা কমবে, একই সময়ে একই পরিবার থেকে থাকা সদস্য কমবে। পরিচালকদের মেয়াদও কমবে। বর্তমানে একজন পরিচালক টানা তিন মেয়াদে ৯ বছর থাকতে পারেন। এটি কমিয়ে ছয় বছর হতে পারে। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনি কাঠামো আন্তর্জাতিক মানের হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েও তা কমাতে পারেনি। পরে তা সার্কুলার দিয়ে ঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার বাড়াতে পারছে না। কেননা ঋণের সুদ ৯ শতাংশের বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে আইএমএফ এ সীমা তুলে দেওয়ার শর্ত দিয়েছে। এটি করলে ঋণ ও আমানতের সুদের হার বাড়বে। তখন ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে সুদ আরোপ করতে পারবে।
বৈদেশিক মুদ্রার বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করা হয় ২০০৩ সালের মে মাসে। কিন্তু এটি পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করত। আইএমএফের চাপে নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু সংস্থাটি চাচ্ছে বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে। এ শর্ত বাস্তবায়ন করলে ডলারের দাম বেড়ে যাবে। তখন আমদানি ব্যয় বাড়বে। টাকার মান কমে যাবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। বাজারে পণ্যমূল্য বাড়বে। এতে বিশেষ করে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের দায় বেড়ে যাবে। আমদানিজনিত ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর কারণে সরকারের ব্যয়ও বাড়বে।
আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নিট রিজার্ভ প্রকাশ করার শর্ত দিয়েছে। এটি করলে রিজার্ভ কমে যাবে। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের রিজার্ভের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। কারণ যে পরিমাণ রিজার্ভ ব্যবহার করার মতো তাই প্রকাশ করতে হবে। বাড়তি প্রকাশ করা যাবে না। একই সঙ্গে নিট রিজার্ভ বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। আগামী ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে হবে। এটি করলে ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের তথ্য জানা যাবে। তখন দুর্নাম ও ঝুঁকির ভয়ে সতর্ক হতে বাধ্য হবে ব্যাংকগুলোও।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে ব্যাংকের স্থিতিপত্রের দুর্বলতা দূর করার পদক্ষেপ নিতে বলেছে আইএমএফ। আগামী জুলাই থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে কমানোর পদক্ষেপ দিতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে বা খেলাপি ঋণের বিপরীতে মূলধন পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ব্যবস্থা নিতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন রাখার জন্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী। একই সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে সমঝোতা স্মারকের শর্ত। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংক খাতের জন্য প্রণয়ন করতে হবে আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড বোর্ড দ্বারা প্রণীত আন্তর্জাতিক আর্থিক রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) সিস্টেম। একই সঙ্গে এটি গ্রহণ করতে হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে ব্যাংকগুলোর হিসাব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ফিরে আসবে এবং আন্তর্জাতিক মানের হবে।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য চালু করতে হবে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা। আগামী জুনের মধ্যে পাইলটভিত্তিতে ব্যাংক খাতে ঝুঁকিভিত্তিক সুপারভিশন ব্যবস্থা চালু করতে একটি পরিকল্পনা দিতে হবে। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা চূড়ান্ত করতে হবে। এছাড়া ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে ঝুঁকিভিত্তিক সুপারভিশন ব্যবস্থা। এতে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়বে।
সংস্থাটির শর্ত মোতাবেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। এর আওতায় আগামী জুনের মধ্যে সংসদে ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ফাইন্যান্স কোম্পানি আইনের সংশোধনী উপস্থাপন করতে বলা হয়। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে সংসদে তুলতে হবে দেউলিয়া আইন ও মানি লোন কোর্ট আইনের সংশোধনী বিল। ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে সংসদে নেগোসিয়েশন ইনস্ট্র–মেন্ট আইনের সংশোধনী সংসদে উপস্থাপন করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে এসব আইনকে। শর্ত অনুযায়ী আগামী জুনের মধ্যে তুলে দিতে হবে ঋণের সুদের হারের সীমা। পরিচালন সক্ষমতার ভিত্তিতে একটি সুদের হারের নীতি চালু করতে হবে। এটি বাস্তবায়ন করতে হবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে।
বৈদেশিক মুদ্রার বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করতে হবে আগামী জুনের মধ্যে। ২০২২ সালের ডলার সংকটের সময় দেশের অর্থনীতিতে প্রবল চাপ পড়ে। যা এখনো অব্যাহত আছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য একটি নিরাপদ গাইডলাইন তৈরি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার সুপারিশগুলো ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ছাড়া আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিগুলো প্রকাশ করতে হবে। এটি মোকাবিলার কৌশল নিতে হবে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলার নীতি হালনাগাদ করতে হবে। আর ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্তভাবে চালু করতে হবে সবুজ অর্থায়নবিষয়ক নীতি।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: