পাকিস্তানে ৭৫ বছরে গ্রেপ্তার হয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রীরা
প্রথম নিউজ, ডেস্ক : মাত্র তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেপ্তার করা হয়েছে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানকে। শনিবার ইসলামাবাদের একটি আদালত তার বিরুদ্ধে দেশটির বহুল আলোচিত তোশাখানা দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার পরপরই গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের এমন ব্যক্তিদের কারাগারে রাখার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; যারা দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দেশটির সংবাদমাধ্যম ডন ডটকম পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের একটি টাইমলাইন তুলে ধরেছে; যারা কোনও না কোনও সময় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হেফাজতে ছিলেন। গত ৯ মে ঢাকা পোস্টে পাকিস্তানের কারাগারে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে ডনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেই প্রতিবেদনটি আজ আবার প্রকাশ করা হলো।
• ষাটের দশকের ইতিহাস
জানুয়ারি ১৯৬২: পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী (সেপ্টেম্বর ১৯৫৬-অক্টোবর ১৯৫৭) ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলকে সমর্থন জানাতে অস্বীকার করেন। পরে ইলেকটিভ বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডারের (ইবিডিও) মাধ্যমে তাকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ১৯৬০ সালের জুলাইয়ে ইবিডিও লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় তাকে।
১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানের ১৯৫২ সালের নিরাপত্তা আইনের আওতায় ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে’ জড়িত থাকার বানোয়াট অভিযোগে করাচির কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয় তাকে।• সত্তরের দশকে গ্রেপ্তার
সেপ্টেম্বর ১৯৭৭: জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭৩ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে রাজনৈতিক এক প্রতিপক্ষকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার দায়ে ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হন তিনি।
লাহোরের হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি খাজা মোহাম্মদ আহমদ সামদানি তাকে মুক্তির আদেশ দিয়েছিলেন। ওই সময় এই বিচারপতি বলেছিলেন, ভুট্টোকে গ্রেপ্তারের আইনি কোনো ভিত্তি নেই। তার এমন মন্তব্যের তিন দিন পর মার্শাল ল রেগুলেশন-১২ এর আওতায় আবারও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এমনকি ভুট্টোকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল পাকিস্তানের এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
• আশির দশকেও গ্রেপ্তার
আগস্ট ১৯৮৫: পাকিস্তানের দুবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেনজির ভুট্টো। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর ১৯৯০ সালের আগস্ট এবং ১৯৯৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। জিয়াউল হকের একনায়কতন্ত্রের (১৯৭৭-১৯৮৮) সময় বেনজির ভুট্টো দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৮৫ সালের আগস্টে বেনজির ভুট্টোর ভাই মারা যান। ওই সময় ভাইয়ের মৃত্যুতে পাকিস্তানে আসেন বেনজির ভুট্টো। পরে তাকে ৯০ দিনের জন্য গৃহবন্দী করা হয়।
আগষ্ট ১৯৮৬: করাচিতে স্বাধীনতা দিবসের এক সমাবেশে সরকারের নিন্দা জানানোয় বেনজির ভুট্টোকে গ্রেফতার করা হয়।
মে ১৯৯৮: লাহোর হাইকোর্টের এহতেসাব বেঞ্চ বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
জুন ১৯৯৮: দেশটির তৎকালীন ‘দ্য পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি’ বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
জুলাই ১৯৯৮: লাহোর হাইকোর্টের এহতেসাব বেঞ্চ বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে আবারও জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
এপ্রিল ১৯৯৯: বেনজির ভুট্টোকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং অবৈধ অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুইস কোম্পানিকে শুল্ক জালিয়াতির সুযোগ করে দেওয়ার দায়ে এহতেসাব বেঞ্চ তাকে সরকারি পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করে। তবে আদালতের রায় ঘোষণার সময় তিনি দেশে ছিলেন না এবং পরে উচ্চ আদালত ওই রায় বাতিল করে।
অক্টোবর ১৯৯৯: এহতেসাব বেঞ্চ সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় আদালতে হাজির না হওয়ায় বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে ফের জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
• চলতি শতকের প্রথম দশকেও গ্রেপ্তার
সেপ্টেম্বর ২০০৭: ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের সরকার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে নির্বাসনে পাঠায়। নির্বাসিত হওয়ার পর ২০০৭ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসেন তিনি। নওয়াজ শরিফ ইসলামাবাদে ফেরার পর সেখানকার বিমানবন্দর অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়। নওয়াজকে ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। ১০ বছরের নির্বাসনের বাকি ৩ বছর কাটানোর জন্য পরে তাকে সৌদি আরবের জেদ্দায় পাঠানো হয়।
নভেম্বর ২০০৭ : জেনারেল মোশাররফের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লং মার্চে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে বিরত রাখতে পাঞ্জাবে পিপিপি সিনেটর লতিফ খোসার বাড়িতে বেনজিরকে এক সপ্তাহের জন্য গৃহবন্দী করে রাখা হয়।
• ২০১০-এর দশক
জুলাই ২০১৮: নওয়াজ শরিফকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ও তার মেয়ে মরিয়ম নওয়াজকে ১০ বছরের সাজা দেয় দেশটির জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী তদন্ত সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো (ন্যাব )। হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়ে সাজা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় দুই মাস পর কারামুক্ত হন নওয়াজ শরিফ।
ডিসেম্বর ২০১৮: সৌদি আরবে ইস্পাতের কারখানায় পরিবারের মালিকানার বিষয়ে দায়ের হওয়া এক মামলায় শরিফকে সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়। পরে আবারও কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। পরের বছরের নভেম্বরে চিকিৎসার জন্য দেশ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয় তাকে। এরপর থেকে তিনি আর পাকিস্তানে ফেরেননি।
জুলাই ২০১৯: পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন শহীদ খাকান আব্বাসি।
কয়েক বিলিয়ন রুপির এলএনজি আমদানির একটি চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগে ন্যাবের ১২ সদস্যের একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে। ২০১৩ সালে তিনি পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রী থাকাকালীন এই চুক্তি হয়েছিল। পরে জামিন পান তিনি এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আদিয়ালা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় তাকে।
সেপ্টেম্বর ২০২০: পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ন্যাবের অর্থপাচারের এক মামলায় লাহোরের হাইকোর্ট তার জামিন প্রত্যাখ্যান করায় গ্রেপ্তার হন তিনি। প্রায় সাত মাস পর লাহোরের কোট লাখপাত কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
মার্চ ২০২৩: পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে পৃথক দুই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ইসলামাবাদের এক বিচারককে হুমকি এবং তোশাখানা উপহার সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে অংশ না নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ওই পরোয়ানা জারি করা হয়।
পরে গ্রেফতার ঠেকাতে জামান পার্কে ইমরান খানের বাসভবনের বাইরে হাজার হাজার পিটিআই সমর্থক-কর্মী জড়ো হন। নিরাপত্তা কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করায় পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে।
মে ২০২৩: আল কাদির ট্রাস্ট মামলায় দুর্নীতির অভিযোগে ৯ মে ইমরান খানকে ইসলামাবাদ হাইকোর্টের চত্বর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
৫ আগস্ট ২০২৩: শনিবার ইসলামাবাদের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালত ইমরান খানকে তোশাখানা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তিন বছরের সাজা ঘোষণার পরপরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সঙ্গে আগামী পাঁচ বছরের জন্য ইমরান খানকে দেশটির সক্রিয় রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করেছে আদালত।