নদীভাঙনে বিলীনের শঙ্কা, তবুও নির্মাণ হচ্ছে ৪০ লাখ টাকার স্কুল ভবন

স্থানীয়রা বলছেন, নদীভাঙনে বিলীন হওয়ার শঙ্কা মাথায় নিয়েই নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ভবনটি বাস্তবায়ন করছে। কারণ নতুন ভবন যত দ্রুত বিলীন হবে তত দ্রুত নতুন প্রকল্প পাবে।

নদীভাঙনে বিলীনের শঙ্কা, তবুও নির্মাণ হচ্ছে ৪০ লাখ টাকার স্কুল ভবন

প্রথম নিউজ, বরিশাল: বিদ্যালয়টির রয়েছে নিজস্ব জমি। তবে ম্যানেজিং কমিটির দৌরাত্মে আরেকজনের জমিতে নির্মাণ হচ্ছে ৪০ লাখ টাকার নতুন ভবন। নির্মাণাধীন ভবন থেকে মাত্র ১৪ ফুট দূরত্বে সন্ধ্যা নদীর ভাঙন। ঘটনাটি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

স্থানীয়রা বলছেন, নদীভাঙনে বিলীন হওয়ার শঙ্কা মাথায় নিয়েই নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ভবনটি বাস্তবায়ন করছে। কারণ নতুন ভবন যত দ্রুত বিলীন হবে তত দ্রুত নতুন প্রকল্প পাবে।

জানা গেছে, বাবুগঞ্জ উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৮৫ সালে সন্ধ্যা নদীগর্ভে বিলীন হয়। এরপরে স্থানীয় একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের ভবনে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হয়। বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে ভবনটি নির্মাণ করেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। সেই থেকে রমজানকাঠী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রটিই রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি পায়। সম্প্রতি বিদ্যালয়ের সেই অস্থায়ী ভবনটিও ভাঙনঝুঁকির মুখে পড়লে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে সরিয়ে নিজস্ব জমিতে নতুন ভবন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। নতুন ভবন তৈরির জন্য ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় এলজিইডি।

নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের চত্বরে থাকা মেহগনিসহ ১০টি গাছ অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করে ম্যানেজিং কমিটি। গাছের বাজারমূল্য ৩ লক্ষাধিক টাকা হলেও তারা এর নিলাম বিক্রি মূল্য নির্ধারণ করে মাত্র ২৬ হাজার টাকা। স্থানীয় বাসিন্দা ফারুক হোসেন বিশ্বাস বলেন, আমরা ফিতা দিয়ে মেপে দেখেছি নতুন স্কুল ভবনের দক্ষিণ পাশের বেইজ পিলার থেকে ভাঙনরত নদী পাড়ের দূরত্ব ঠিক ১৪ ফুট। বর্ষা মৌসুমের আগেই ভাঙনে এই জায়গার স্থাপনাসমূহ নদীগর্ভে বিলীন হবে। তবুও এলজিইডি কোনো স্বার্থে নদী ভাঙনের এতটা কাছে নতুন এই ভবন নির্মাণ করছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। এখানে বহুমুখী লুটপাটের একটা সংঘবদ্ধ আয়োজন চলছে। যারা নির্মাণ করছে তারাও জানে ভবনটি নদী ভাঙনে বিলীন হবে। বিলীন হলে নতুন প্রকল্প পাবেন। তাছাড়া তড়িঘড়ি করে নিম্নমানের কাজ করে টাকা লোপাট করতে পারছে।

রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমিদাতার ছেলে সাইফুর রহমান সোহেল বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমোদন, জেলা জজ আদালতের রায়, উপজেলা শিক্ষা কমিটির রেজ্যুলেশনের সিদ্ধান্ত সবকিছুই এখানে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। শুধু ম্যানেজিং কমিটির একটা কথিত রেজ্যুলেশনের ক্ষমতা বলে লুটেরা চক্রের স্বার্থ হাসিলের জন্য সম্পূর্ণ খামখেয়ালি থেকে নদীর পাড়ে অবৈধ জমিতে স্কুল ভবন নির্মাণ করছে এলজিইডি।

রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তৃপ্তি রানী চন্দ্র বলেন, যেখানে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে সেই স্থানটি বাচ্চাদের স্কুলের জন্য উপযুক্ত না। জায়গাটি নদীভাঙন পাড়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া এই জমিটিও স্কুলের বৈধ জমি নয়। স্কুলের নিজের নামে জমি থাকতে কেন আরেক জমিতে স্কুলটি নির্মাণ হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শরীফ জিয়া উদ্দিন বলেন, স্কুল থেকে নদীভাঙন খুব কাছে এটা সত্যি। তবে এখানে নতুন স্কুল ভবন করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু টাকা পয়সা খরচ করতে হয়েছে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের বর্তমান ভবনটির পেছন ঘেঁষে নতুন ভবনটি করা হচ্ছে। যে জায়গা দেখিয়ে বরাদ্দ আনা হয়েছে সেখানেই ভবন করা হচ্ছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।

এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম বলেন, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি রেজ্যুলেশন করে সাইট সিলেকশন করেছে। আমরা শুধু ঠিকাদার দিয়ে নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছি। তাছাড়া ম্যানেজিং কমিটি যথেষ্ঠ টাকা পয়সা খরচ করে সেখানে চর ডিজাইনের নতুন ভবনের জন্য ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ এনেছে। সুতরাং ভবনটি ওখানেই করতে হবে। তাছাড়া ওটা যদি নদীতে ভেঙে যায় তখন এমনিতেই স্কুল মূল জমিতে সরিয়ে নেওয়া হবে। বিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্রয়কৃত এবং রেকর্ডীয় জমি থাকতেও নদী ভাঙন কবলিত অবৈধ জমিতে কেন সরকারি অর্থ অপচয় করবেন, এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুনিরুল হক বলেন, রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মালিক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। কোথায় স্কুল হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন মহাপরিচালক। সেখানে ম্যানেজিং কমিটির সাইট সিলেকশন করার কোনো এখতিয়ার নেই। দলিল অনুযায়ী গ্রামবাংলা বিদ্যাপীঠ হাইস্কুলের পাশের মজানকাঠী মৌজার ৪০০ নম্বর খতিয়ানের ১৩৮ ও ১৪০ নম্বর দাগের ৩৬ শতাংশ জমি রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রকৃত জমি। যা নিয়মানুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজির নামে দলিল করা এবং ভূমি অফিস থেকে মিউটেশন করা। নদী পাড়ের ওই জমি স্কুলের নয়। এটা এলজিইডিকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে। তারপরেও সেখানে কীভাবে নতুন স্কুল ভবন নির্মাণ হচ্ছে সেটা আমরা জানি না।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাকিলা রহমান বলেন, রমজানকাঠী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ বিষয়ক জটিলতার কথা আমি জেনেছি। স্কুল নির্মাণের জমি নির্ধারণ করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সেখানে নিয়মানুযায়ী ঠিকাদারের মাধ্যমে নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করবে এলজিইডি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্ধারিত জমির পরিবর্তে কেউ যদি অন্যত্র স্কুল ভবন নির্মাণের চেষ্টা করে, সেই দায়ভার তাকেই নিতে হবে।