দূরপাল্লায় বাস ভাড়া কোথাও কম, কোথাও বেশি

জায়গা ভেদে কোনো কোনো অঞ্চলের রুটে তারা বেশি ভাড়া আদায় করেন বলে যাত্রীদের অভিযোগ।

 দূরপাল্লায় বাস ভাড়া কোথাও কম, কোথাও বেশি

প্রথম নিউজ, ঢাকা : রাজধানী থেকে সারা দেশের ৪৩২টি আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে বাস চলাচল করে। এসব বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। রুটভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) দেওয়া দূরত্ব, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও সওজ’র আওতাধীন ব্রিজ, টোল ও ফেরির ভাড়ার তালিকা অনুসরণ করা হয়। কিন্তু এই ভাড়া নির্ধারণ করা থাকলেও তা মানেন না কোনো বাস মালিকই। জায়গা ভেদে কোনো কোনো অঞ্চলের রুটে তারা বেশি ভাড়া আদায় করেন বলে যাত্রীদের অভিযোগ।

প্রায় বছর খানেক আগে সর্বশেষ বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সারা দেশে গণপরিবহনের ভাড়াও বাড়ানো হয়। তখন ঢাকা থেকে দূরপাল্লার পথে আগের তুলনায় বাড়ে ২২ শতাংশ ভাড়া। চালক ছাড়া ৪০ সিটের বাসে প্রতি কিলোমিটার পথের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ২ টাকা ১৫ পয়সা।

২০২১ সালে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর দূরপাল্লার বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালে আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে ৪০ পয়সা বাড়িয়ে করা হয় ২ টাকা ২০ পয়সা। পরে আবার সেটি সমন্বয় ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর ৫ পয়সা কমিয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। যা এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। সে হিসেবে ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কিলোমিটার প্রতি দূরপাল্লার রুটে বাস ভাড়া বেড়েছে ৭৩ পয়সা।

দূরপাল্লার রুটে বাস যাত্রীদের অভিযোগ, প্রতিটি রুটের বাসে বেশি ভাড়া আদায় করা হয়। বিআরটিএ নির্ধারিত ৪৩২টি রুটের মধ্যে অন্তত ৪০টি রুটের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। তাদের দেওয়া তথ্য ও বিআরটিএর তথ্যমতে দেখা যায়—

নুরুদ্দীন তসলিম ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, গাবতলী থেকে পঞ্চগড় সদরের বাস ভাড়া নেয় ১১০০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৭০০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (গাবতলী) থেকে পঞ্চগড়ের (রুট-৯৩) দূরত্ব ৪২৪ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ১১৯৭ টাকা। সে হিসেবে এই পথে ৯৭ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে কম নেন বাস মালিকরা।

আবু সালেহ সায়দাত ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, গাবতলী থেকে রাজশাহী সদরের বাস ভাড়া নেয় ৭১০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৪৮০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (গাবতলী) থেকে রাজশাহীর (রুট-৮২) দূরত্ব ২৪৭ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ৭১২ টাকা। সে হিসেবে এই পথে ২ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে কম নেন বাস মালিকরা।
সরকার এসি বাস এবং ট্রাকের ভাড়া নির্ধারণ করে না। এসি বাসে যে যেমন সুবিধা দিতে পারে, সে তেমন ভাড়া নেবে
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব

জসীম উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, গাবতলী থেকে গাইবান্ধা সদরের বাস ভাড়া নেয় ৭০০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (গাবতলী) থেকে গাইবান্ধার (রুট-৮৭) দূরত্ব ২৬৮ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ৭৬৯ টাকা। সেই হিসেবে এই পথে ৬৯ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে কম নেন বাস মালিকরা।

নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, সায়দাবাদ থেকে লক্ষ্মীপুর সদরের বাস ভাড়া নেয় ৫৫০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (সায়দাবাদ) থেকে লক্ষ্মীপুরের (রুট-৫৬) দূরত্ব ১৭৭ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ৪৯৬ টাকা। সেই হিসেবে এই পথে ৫৪ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি নেন বাস মালিকরা।

আতিকুর রহমান মুন ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, সায়দাবাদ থেকে বরিশাল সদরের বাস ভাড়া নেয় বাস ভেদে ৫০০-৭০০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৪৫০-৫০০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (সায়দাবাদ) থেকে বরিশালের (রুট-৩৫) দূরত্ব ১৫৬ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ৫২৪ টাকা। সে হিসেবে এই পথে বাস ভেদে ১০০-২০০ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি নেন বাস মালিকরা।

নাইমুর রহমান নাবিল ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, মহাখালী থেকে শেরপুর সদরের বাস ভাড়া নেয় ৫০০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (মহাখালী) থেকে শেরপুরের (রুট-২১৯) দূরত্ব ১৮৮ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ৫১৭ টাকা। সে হিসেবে এই পথে ১৭ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে কম নেন বাস মালিকরা।

জুন্নুন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, মহাখালী থেকে হবিগঞ্জ সদরের বাস ভাড়া নেয় ৪৬০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৩৫০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (মহাখালী) থেকে হবিগঞ্জের (রুট-৪১৫) দূরত্ব ১৬৭ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ৪৬৭ টাকা। সে হিসেবে এই পথে ৭ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে কম নেন বাস মালিকরা।

সামিউল ইসলাম শোভন জানিয়েছেন সায়দাবাদ থেকে কক্সবাজার সদরের বাস ভাড়া নেয় ১২০০ টাকা। ২০২১ সালেও এই পথে ভাড়া ছিল ৮০০ টাকা। অন্যদিকে বিআরটিএর হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকা (সায়দাবাদ) থেকে কক্সবাজারের (রুট-৪৯) দূরত্ব ৩৯৬ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে টোলসহ আদায়যোগ্য ভাড়া ১০৯৯ টাকা। সে হিসেবে এই পথে ১০১ টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি নেন বাস মালিকরা।

যাত্রীদের দেওয়া তথ্য ও বিআরটিএর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন দূরত্বের দূরপাল্লার বাসগুলো কোথাও ভাড়া বেশি আদায় করছে, আবার কোথাও কম। তবে কম আদায় করার সংখ্যাই বেশি। তবে এর মূল কারণ হিসেবে বিআরটিএ ও পরিবহন মালিকরা উল্লেখ করেছেন প্রতিযোগিতার বিষয়টি।

ঢাকা-সরিষাবাড়ী রুটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বাসের মালিক ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, বিআরটিএর তালিকা অনুযায়ী ঢাকা (মহাখালি) থেকে সরিষাবাড়ীর (রুট-৭) দূরত্ব ১৬৬ কিলোমিটার। এই পথে ৪০ সিটের বাসে আদায়যোগ্য ভাড়া ৪৫৫ টাকা। কিন্তু আমরা ওই সমপরিমাণ ভাড়া যাত্রীদের কাছ থেকে নিতে পারি না। কারণ, এত টাকা ভাড়া দিয়ে কেউ যেতে চায় না। অনেক লোকাল বাস আবার ৩০০ টাকাতে নিয়ে যায়। যার ফলে আমাদের ক্ষতি হয়। ওই পরিমাণ ভাড়া চাইলে ৪০ সিটের মধ্যে ৩০ সিটই খালি যাবে। তাও যাত্রী পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। তাই আমরা ৩২০-৩৫০ টাকা নিয়ে থাকি। এতে বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়া পূরণ না হলেও বাস খালি যায় না। হয়তো কখনও ৩/৪টা সিট খালি যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার এসি বাস এবং ট্রাকের ভাড়া নির্ধারণ করে না। এসি বাসে যে যেমন সুবিধা দিতে পারে, সে তেমন ভাড়া নেবে। এসি বাস ২ কোটি টাকা দামেরও আছে আবার ৩ কোটি টাকা দামেরও আছে।

তিনি আরও বলেন, সরকার নন এসি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। অনেকে প্রতিযোগিতার কারণে কম ভাড়ায় ওই রুটে বাস চালায়। কিন্তু স্বনামধন্য কোম্পানিগুলো কখনও কম ভাড়ায় বাস চালায় না। যেমন- এনা, সোহাগ, গ্রিন লাইন ইত্যাদি। এরা কখনোই কম ভাড়ায় প্রতিযোগিতা করে বাস চালায় না। প্রতিযোগিতার জন্যই অন্যান্য বাস কোম্পানিগুলো কম ভাড়ায় চালায়। আর এই সুবিধা নিয়ে থাকে যাত্রীরা।

বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো কোম্পানি চাইলে সরকার নির্ধারিত বাস ভাড়ার চেয়ে কম ভাড়া নিতে পারে যাত্রীর কাছ থেকে। তবে বেশি ভাড়া নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আমরা যখন ভাড়া নির্ধারণ করি তখন ম্যাক্সিমাম ভাড়াটাই নির্ধারণ করে থাকি। যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতার কারণে বাস মালিকরা এটা করে থাকতে পারে।