ড্রেজিং বন্ধের চেষ্টা, মোংলা বন্দর অচলের শঙ্কা
একটি মহল বন্দরের কার্যক্রম থমকে দিতে চলমান ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্প বন্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হলে মোংলা বন্দরে আবারও অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রথম নিউজ, ঢাকা: পশুর নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত বাগেরহাটের মোংলা বন্দরে কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে। পদ্মা সেতু, খানজাহান আলী বিমান বন্দর, রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, খুলনা-মোংলা রেললাইন, পদ্মা সেতু সংলগ্ন ভাঙ্গা-মোংলা মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ, গাড়ি আমদানি, দেশের চলমান মেগা প্রকল্পের মালামাল আমদানি, গার্মেন্টস পণ্য রফতানিসহ নানাবিধ কাজে এই বন্দর ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে একটি মহল বন্দরের কার্যক্রম থমকে দিতে চলমান ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্প বন্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হলে মোংলা বন্দরে আবারও অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, একটি বন্দরের প্রধান চালিকা শক্তি চ্যানেল বা নৌপথ। সেই চ্যানেল যদি সুরক্ষিত না থাকে তাহলে বন্দরের পণ্যবাহী বড় বড় বিদেশি জাহাজের আগমন বাধাগ্রস্ত হবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বন্দরের আমদানি-রফতানিসহ জাতীয় অর্থনীতিতে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশ্বের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক সুরক্ষিত (সুন্দরবনবেষ্টিত) সমুদ্রবন্দর মোংলা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নে এই বন্দরের ভূমিকা অপরিসীম হওয়ায় অপার সম্ভাবনার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে মোংলা। কিন্তু দেখা যায়, ২০০২-২০০৩ থেকে ২০০৬-২০০৭ অর্থবছর পর্যন্ত এটি ‘লোকসানের বন্দর’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ওই সময় এই বন্দরকে মৃতপ্রায় অর্থাৎ ‘ডেডহর্স’ বলেও ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোংলা বন্দরের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে একাধিক প্রকল্পের অনুমোদন দেন। সেই সব প্রকল্প বাস্তবায়নে ও বাস্তবাবায়নাধীন অবস্থায় বন্দর ‘লোকসানী বন্দরের’ নাম মুছে আজ একটি অর্থনৈতিকভাবে সুদৃঢ় বন্দর হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেছে।
বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ১৩১ কিলোমিটার উজানে পশুর নদীর পূর্ব তীরে মোংলা বন্দর অবস্থিত। বঙ্গোপসাগর হতে বন্দর চ্যানেলের প্রবেশ মুখ, যা আউটাবার নাম হিসেবে পরিচিত। বন্দরের প্রবেশ মুখ থেকে চ্যানেলের হাড়বাড়িয়া পর্যন্ত আউটারবার। সম্প্রতি এই আউটাবার ড্রেজিং করায় মোংলা বন্দরের হাড়বাড়ীয় পর্যন্ত সাড়ে ৯ থেকে ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ অনায়াসে ভিড়তে পারছে। আর হাড়বাড়ীয় থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার নৌপথে গভীরতা ৫-৬ মিটার। ইনারবারে সাড়ে ৮ মিটার গভীরতার ড্রেজিং সম্পন্ন হলে বন্দর জেটিতে সাড়ে ৯ থেকে ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়তে পারবে। পশুর চ্যানেলের ইনারবার ড্রেজিং সম্পন্ন হলে মোংলা বন্দরকে চট্টগ্রাম বন্দরের সমান সক্ষমতার বন্দরে পরিণত হবে।
ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্পের পরিচালক ও মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল ও হাইড্রোলিক্স বিভাগ) শেখ শওকত আলী জানান, ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার আগে ২০১৮ সালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। এতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও জমির মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলার জন্য জমি নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত জমিতে ড্রেজিংয়ের পলি মাটি ফেললে তাতে ফসলের জন্য উপকারী হবে। এছাড়া ওই নিচু জমিতে জোয়ারের সময় প্লাবিত হয়ে স্থানীয়দের ক্ষতি হয়ে আসছে। তাই ড্রেজিংয়ের মাটি ফেললে স্থানীয় জনবসতি প্লাবিত হবে না এবং নদী ভাঙনের আশঙ্কা মুক্ত হবে। কিন্তু ওই জমিতে ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলায় বাধা সৃষ্টি করে আন্দোলনের নামে একটি মহল সরকারের উন্নয়নকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
শেখ শওকত আলী বলেন, ‘একটি কুচক্রী মহল জমি মালিকদেরকে ভুল বুঝিয়ে নানা আন্দোলন সৃষ্টি করে সেখানে মাটি ফেলায় বাঁধার সৃষ্টি করছেন। যারা এসব করাচ্ছেন তাদের সেখানে কোনও জমিও নেই। পশুর চ্যানেলের এ ড্রেজিংয়ের কাজ বন্ধ হলে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে। এ কারণে প্রকল্প চলমান রাখা জরুরি। মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে ১০ মিটারের অধিক গভীরতা সম্পন্ন জাহাজ হ্যান্ডেলিংয়ে পশুর চ্যানেলের ইনারবার ড্রেজিং বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। ইনারবার ড্রেজিং প্রকল্পটি ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি অনুমোদন পায়। ৭৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তাবায়ন করা গেলে মোংলা বন্দর জেটি ও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সাড়ে ৯ থেকে ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ হ্যান্ডেলিং করা সম্ভব হবে।
মোংলা বন্দর বার্থ অ্যান্ড শিপ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, ‘মোংলা বন্দর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অন্যতম চাবিকাঠি। ইনারবার ড্রেজিং কার্যক্রম যদি কেউ ব্যাহত করে কিংবা করতে চায় তা বন্দরের জন্য ভীষণ ক্ষতির কারণ হবে। এতে আমদানি-রফতানি ও অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে।’
শিপিং এজেন্ট এনসিয়েন্ট স্টিমশিপ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘বন্দরে জাহাজ আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জরুরি প্রয়োজন নদীর নাব্যতা। আর নাব্যতা ঠিক রাখতে ড্রেজিংয়ের বিকল্প নেই। ড্রেজিং সম্পন্ন করতেই হবে, নতুবা বড় বড় জাহাজ আসতে পারবে না। ড্রেজিং জটিলতায় নাব্যতা কমে গেলে জাহাজ আসতে না পারলে মেট্টোরেলের মালামাল আসবে কী করে? তাই বন্দরের উন্নয়নের ড্রেজিংকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা প্রতিহত করতে হবে।’
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘বন্দরের পশুর চ্যানেলের ইনারবারে চলমান ড্রেজিং প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হলে জাতীয় অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিঃস্বার্থভাবে ও দূরদর্শিতার সঙ্গে বন্দর পরিচালনা করে আসছে। চলমান এ প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বন্দর সংশিষ্টদের সহযোগিতা দরকার।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:
https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews