ডিবি পরিচয়ে বিএনপি নেতা হিরুর বাসা থেকে টাকা নিলো কারা?
রাজধানীর কলাবাগান প্রথম লেনের ৫৩নং বাড়ি। ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন ৪ ব্যক্তি। প্রত্যেকেই লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: ২১শে নভেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ৭টা। রাজধানীর কলাবাগান প্রথম লেনের ৫৩নং বাড়ি। ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন ৪ ব্যক্তি। প্রত্যেকেই লম্বা ও সুঠাম দেহের অধিকারী। বাসায় ঢুকে প্রথমে নিজেদের পরিচয়ও দেননি। ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জামাল শরীফ হিরুর খোঁজ করেন। একপর্যায়ে তারা ২৮শে অক্টোবর নয়াপল্টনে সহিংসতার ঘটনায় হিরুকে গ্রেপ্তার করতে এসেছেন বলে জানান। কিন্তু বাধা দেন হিরুর স্ত্রী। তিনি তার স্বামীর শারীরিক অবস্থার চিকিৎসাপত্র, পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র দেখিয়ে কাকুতি মিনতি করেন। মন গলেনি ওই ৪ ব্যক্তির।
একপর্যায়ে তারা হিরুকে পাশের একটি কক্ষে নিয়ে ৫ লাখ টাকা দিলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না বলে জানান। এত টাকা দিতে রাজি হননি হিরু। এ ছাড়া এত টাকা বাসায় রাখা হয় না বলে জানান তিনি। একপর্যায়ে ৪ ব্যক্তির একজন টাকা না দিলে স্বর্ণালঙ্কার দেয়ার প্রস্তাব করেন। এতেও অপারগতা দেখান হিরু। পরে তিনি এ বিষয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন। ততক্ষণে হিরু, তার স্ত্রী ও বাসায় থাকা স্বজনদের মধ্যে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে। তারা কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছিলেন না। যদিও তখন ওই ৪ ব্যক্তি পেশাগত পরিচয়পত্র না দেখিয়ে নিজেদেরকে ডিবি’র সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। তখন হিরুর স্ত্রী তাদেরকে ১ লাখ টাকার প্রস্তাব করেন। রাজি হয়ে যান ওই ৪ ব্যক্তি। হিরুর স্ত্রী বিভিন্নভাবে টাকার ব্যবস্থা করে তাদের হাতে তুলে দেন। পরে ডিবি সদস্য পরিচয় দানকারী ব্যক্তিরা বাসা ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে তারা হিরুর স্ত্রীর কাছ থেকে একটি ভিডিও বার্তা নিয়ে যান। পাশাপাশি তারা ওই বাসায় সিটি ক্যামেরার সমস্ত ফুটেজ নিয়ে যান।
কলাবাগানের যে বাড়ির ফ্ল্যাটে ডিবি পরিচয় দিয়ে ১ লাখ টাকা নিয়ে গেছে ৪ ব্যক্তি ওই বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক বিএনপি’র জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, শরীয়তপুর জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি ও সাবেক ছাত্রনেতা জামাল শরীফ হিরু। তার স্ত্রী শামীমা আখতার সাথী গতকাল মানবজমিন’র কাছে ওইদিনের ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন। অভিযোগ করে তিনি বলেন, ওইদিন আমার দুই বোন ও তাদের সন্তানেরা বাসায় এসেছিল। আমি তাদের জন্য নাস্তা তৈরি করছিলাম। ওই সময় ৪ জন বাসায় প্রবেশ করে। প্রথমে কালো শার্ট পরা লম্বা এক ব্যক্তি বাসায় প্রবেশ করেই হিরু ভাই কেমন আছেন বলে ডাক দেয়। তার পরেই আরও ৩ জন প্রবেশ করেন। যখন হিরু ভাই বলে ডাক দিয়েছে তখনই আমাদের সন্দেহ হয়েছে। কারণ একজন পলিটিক্যাল পার্সন কিন্তু এরকম অ্যাটিচিউড দেখাবে না। আগে সালাম দিবে তারপর কথা বলবে। অথচ তাদের অ্যাটিচিউড খারাপ ছিল। তাদের গায়ে ডিবির পোশাক, জ্যাকেট বা আর্মস ছিল না। পরে তারা হিরুর পাশে এসে বসে। হিরুকে তারা প্রশ্ন করে ২৮ তারিখের প্রোগ্রামে কি আপনি গিয়েছিলেন। তখন হিরু বলে- হ্যাঁ গিয়েছিলাম। তখন তারাও মোবাইল থেকে ওই দিনের প্রোগ্রামের একটি ছবি বের করে দেখিয়েছিল। যেটাতে হিরু ওইদিন বিএনপি’র মহাসমাবেশের স্টেজের পেছনের সারিতে ছিল। ছবি দেখানোর পর সে মনে করে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। সেটা বুঝেই হিরু ভয় পেয়ে যায় এবং কান্নাকাটি শুরু করে। তারা হিরুকে আটক করে নিয়ে যাবে বলে আমাদেরকে জানায়। তখন আমিও কান্নাকাটি করি। হিরু অসুস্থ। সাম্প্রতিক সময়ে তার কিডনি ডায়ালাইসিস সহ অন্যান্য ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, শারীরিক পরীক্ষা-নীরিক্ষার কাগজপত্র তাদেরকে দেখাই। এসব দেখার পরও তারা হিরুকে নিয়ে যেতে অনড়। তখন আমি তাদেরকে অনেক কাকুতি-মিনতি করি। এরপর তারা হিরুকে পাশের একটি রুমে একা কথা বলার জন্য নিয়ে যায়। ওই রুমে গিয়ে তারা হিরুর কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা দিলে তারা ছেড়ে দিবে।
তখন হিরু বলে, আমার কাছে এত টাকা নাই। আর এই পরিমাণ টাকা ঘরে রাখার কোনো সুযোগই নাই। আমি এত টাকা দিতে পারবো না। তারা বলে তাহলে স্বর্ণালঙ্কার দিয়ে দেন। ওই সময় হিরু তাদেরকে বলে আপনারা যে গহনা চাচ্ছেন এসব কথা বললে মানুষ আপনাদের সন্দেহ করবে। এ কথা বলার পর তাদেরই একজন বলে ওর কথা ধইরেন না। একেক জনের বুঝ একেক রকম হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে হিরু তাদেরকে জানায়, ঘরে ২৮ হাজার টাকা আছে। ৮ হাজার টাকা রেখে বাকিটা আপনারা নিয়ে যান। তারা রাজি না হওয়াতে হিরু আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাদেরকে অনুরোধ করে। আমার সঙ্গেও তারা টাকা নিয়ে কথা বলে। আমি তখন আমার স্বামীকে বাঁচাতে ১ লাখ টাকা দিতে রাজি হই। ঘরে এত টাকা ছিল না। আমার বাসায় বোন ছিল তার কাছ থেকে কিছু টাকা এবং ধারদেনা করে মিলিয়ে ১ লাখ টাকার ব্যবস্থা করে দেই। যতক্ষণ টাকার ব্যবস্থা হয়নি ততক্ষণ তারা বাসায়ই ছিল। টাকা দেয়ার পর তারা আমার কাছ থেকে একটি স্টেটমেন্ট নিয়ে গেছে। সেখানে তারা আমাকে দিয়ে বলিয়েছে, আজ ২১শে নভেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ডিবি পুলিশ আমার বাসায় এসেছিল আমার স্বামী জামাল শরীফ হিরুকে আটক করতে। আমার স্বামীর শারীরিক অবস্থা খারাপ দেখে মানবিক কারণে পুলিশ তাকে নেয়নি। এ ব্যাপারে আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি বা অভিযোগ নাই।
শামীমা আখতার সাথী বলেন, বিএনপি’র রাজনীতি করাটাই একটা অপরাধ। আমার স্বামীতো ওইদিন কোনো নাশকতার সঙ্গে জড়িত ছিল না। শরীর খারাপ ছিল। তাই সকালে গিয়ে দুপুরের মধ্যে নাশকতা শুরুর আগেই বাসায় চলে আসে। এ ছাড়া আমার ভাসুর কামাল শরীফ কলাবাগান থানা আওয়ামী লীগের ট্রেজারার। যারা বাসায় এসেছিল তাদেরকে তিনি পরিচয় দিয়েছেন। কেন তারা এসেছে, কোথা থেকে এসেছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেছে। তারা আমার ভাসুরকে বলে- আপনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন তাহলে কি জানেন না যারা ওইদিন নাশকতা করেছিল তাদেরকে ধরার নির্দেশ আছে। পরে আমার ভাসুর বলেছেন- যারা নাশকতা করেছে তাদেরকে ধরবেন। আমার ভাইতো নাশকতা করেনি। তাকে কেন ধরতে এসেছেন। এ ছাড়া তারা আমাকেও বলেছিল আপনার স্বামীকে ধরার জন্য সরকার ২ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
শামীমা বলেন, তাদেরকে দেখেই আমার খটকা লেগেছে। কারণ আসামি ধরতে আসলে গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু তাদের অ্যাচিটিউডই খারাপ ছিল। ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল। আমাদের বাসা থেকে তিন নম্বর বাসার সামনে তারা গাড়ি রেখেছিল। কালো গ্লাসের মাইক্রোবাস ছিল। বাসার গেট দিয়ে জোর করে প্রবেশ করেছে। দারোয়ানদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহার করেছে। তিনি বলেন, আমি অনেক ভেবেচিন্তে তাদেরকে টাকা দিতে রাজি হয়েছি। কারণ টাকা না দিলে তারা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাবে। পরে থানায় গেলে বলবে তারা জানে না। ডিবি ও র্যাবে গেলে বলবে তারাও জানে না। এ রকম হলে আমি কোথায় গিয়ে খুঁজবো আমার স্বামীকে। এজন্য টাকার মায়া না করে আমি আমার স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। ওই ঘটনার খবর পেয়ে ডিবির ধানমণ্ডি-কলাবাগানের যারা দায়িত্বে আছেন তারা আমাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। তারা আমাদেরকে জানিয়েছেন, তাদের কেউ ওইদিন সন্ধ্যায় অভিযানে আসেননি। কারা এসেছিল তারা সেটিও জানে না। তবে তারা সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। আশপাশের ভবনের সিসিটিভির ফুটেজ দেখলেই তাদের চিহ্নিত করা যাবে।
হিরুর বাসার দীর্ঘদিনের গৃহপরিচারিকা ফাতেমা বলেন, কালো রংয়ের গাড়িতে ১০/১২ জন ছিল। গাড়ি থেকে নেমে তারা জ্যাকেট পরা নিয়ে কথা বলছিল। একপর্যায়ে জ্যাকেট না পরেই তারা বাসার দিকে যায়। বাসার দারোয়ান হোসেন বলেন, আমরা তখন গেটে ডিউটি করছিলাম। তখন একটি প্রাইভেট কার আসে। শাকিল গেট খুলে দিলে ওই গাড়ি প্রবেশ করে। তার ঠিক পেছন পেছন তারাও ঢোকে। ওইদিন বাসার মোটর নষ্ট হয়েছিল। পুরো ভবনে পানির সমস্যা ছিল। আমরাও খুব ক্লান্ত ছিলাম। গেটের ভেতরে প্রবেশ করে আমাকে একজন ধরে রাখে। শাকিলকে ২/৩ জন মিলে ধরে লিফট দিয়ে হিরু স্যারের বাসার সামনে নিয়ে যায়। দারোয়ান শাকিল বলেন, ফ্ল্যাটের সামনে এসে তারা বলে তুমি কলিং বেল চাপ দেও। কেউ কিছু বললে বইলো তুমি চাপ দিয়েছো। পরে দরজা খোলার পর তারা ভেতরে প্রবেশ করে। বাসার নিচে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আমাদেরকে পাহারা দিচ্ছিল। আমরা বাথরুমে যাওয়ার সময়ও তারা পেছন পেছন আসে। গেটের বাইরেও কয়েকজন ছিল। বড় স্যার গেটে প্রবেশের সময় তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিল তারা কারা। কিন্তু তারা কোনো পরিচয় দেয়নি। কথা বলতে চাইলে তারা ওনাকে উপরে নিয়ে আসে। সুরুজ নামের আরেক কেয়ারটেকার বলে, যে গাড়িতে তারা এসেছিল ওই গাড়ির সামনে ‘ডি’ লেখা ছিল।
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে যদি এমন আচরণ হয়, তাহলে সারা দেশের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কী চলছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গ্রেপ্তারের বিভীষিকা পর্ব তুলে ধরলে কেউ অশ্রু ধরে রাখতে পারবে না। এমন নির্মম ঘটনা ঘটছে। এমন করুণ কাহিনী শুনে সবাই বিস্মিত হবেন। অথচ গ্রেপ্তার বাণিজ্যের এমন ঘটনা সারা দেশে অহরহ ঘটছে।
এদিকে, অসুস্থ এই বিএনপি নেতার বাসায় গিয়ে তাকে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে কারা টাকা নিয়ে গেছে এ নিয়ে ডিএমপি তদন্ত শুরু করেছে। বিষয়টি ডিবি’র সংশ্লিষ্ট রমনা জোনের ডিসি, ডিবি’র অতিরিক্ত কমিশনার থেকে ডিএমপি কমিশনার পর্যন্ত জানেন। বিএনপি নেতার স্ত্রীর এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এই বিষয়ে আমি অবগত আছি। ডিবি’র পরিচয় দিয়ে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে ৫ লাখ টাকা চেয়ে ১ লাখ টাকা নিয়ে আসছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি আসলে কারা ওইদিন গিয়েছিল। তারা আসল ডিবি সদস্য নাকি ডিবি’র নাম ভাঙিয়ে এরকম করেছে। গ্রেপ্তার করতে গিয়ে টাকা নিয়ে আসার ঘটনা এর আগে আমি কখনো শুনিনি। যদি আসল ডিবি অভিযানে যায় তবে তারা জ্যাকেট পরে যাবে। এ ছাড়া তাদের জ্যাকেটে কিউআর কোড থাকবে। তিনি বলেন, যেই হোক না কেন। আমরা তাদেরকে খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনবো।