টাকা ছাপিয়ে ‘অচল ব্যাংক’ টিকিয়ে রাখা যাবে না

টাকা ছাপিয়ে ‘অচল ব্যাংক’ টিকিয়ে রাখা যাবে না

প্রথম নিউজ, ঢাকা : টাকা ছাপিয়ে ‘অচল ব্যাংক’ টিকিয়ে রাখার দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, কয়েকটি ব্যাংককে ‘রক্ষার নামে’ টাকা ছাপানো অব্যাহত রাখলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। একই সঙ্গে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। তাই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার স্বার্থে এখন টাকা ছাপানো বন্ধ করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এই নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, অন্য দেশ থেকে ধার করে রিজার্ভ বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে বেশি দিন রিজার্ভ বাড়ানো যাবে না। রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় ও অর্থ পাচার বন্ধের মতো টেকসই পদ্ধতি ব্যবহার করে রিজার্ভ বাড়াতে হবে। এখন প্রবাসী আয়ে যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, তা বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ, ডলারের দাম বাজারভিত্তিক হয়ে গেছে। এসব প্রণোদনা খাচ্ছে দুবাইয়ের কিছু প্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে যুক্ত স্বার্থান্বেষী মহল।

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার কারণ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন আহসান এইচ মনসুর। শনিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ মিলনায়তনে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনা হবে। কিন্তু ৬ মাস পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এটা খুবই হতাশাজনক। দেশের স্বার্থেই এখন ব্যাংক খাতের সংস্কার খুবই জরুরি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে, সেটা ভালো। কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সংস্কার দরকার। আমরা আমানত খেয়ে ফেলেছি। এভাবে কত দিন ব্যাংক চলবে? ব্যাংক খাত নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার। সেটা করতে হবে সরকারকেই। বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে নয়। ব্যাংক খাতে আজ যে অবস্থা হলো, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশে আর্থিক খাতে দীর্ঘদিন সংস্কার হয়নি। ফলে এই বাজারের উন্নতি ঘটেনি। এখন ব্যাংক আমানতের নিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঋণের সুদহার বাড়ছে। আসলে সম্পদ বাইরে চলে যাওয়া অব্যাহত থাকলে এসব ঠিক হবে না। তাই দেশের আর্থিক খাতের সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো বিকল্প নেই।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, আর্থিক দুরবস্থার কারণে বাংলাদেশ দিন দিন ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। এমনকি ধীরে ধীরে দেশের ঋণ পাওয়ার সক্ষমতাও কমছে। ভারত থেকে হতাশ হয়ে আসতে হয়েছে, চীনও সাড়া দেয়নি। অন্যদিকে পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় করতে পারছে না সরকার। ফলে এখন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাও নেই, ডলারও নেই। এ জন্য জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতের বিল পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। অনেক বিদেশি কোম্পানি তাদের দেশে অর্থ নিতে পারছে না।

রপ্তানির হিসাবে বড় ধরনের গরমিল বের হয়েছে এ কথা উলে­খ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, বড় গরমিল আছে আর্থিক খাতের নানা তথ্যেও। খেলাপি ঋণ ১১ শতাংশ বলা হলেও তা আসলে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এই খাতের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ না করে কার্পেটের নিচে রেখে দিলে এক সময় দুর্গন্ধ বের হবেই। এভাবে সমস্যা জিইয়ে রাখলে কোনো সমাধান আসবে না।

তিনি বলেন, কয়েকটি ব্যাংক ঋণ আদায় না করে ঋণের সুদকে আয় দেখিয়ে বেশি মুনাফা দেখাচ্ছে। সেই মুনাফার অর্থ থেকে লভ্যাংশ দিচ্ছে, আবার সরকারকে করও দিচ্ছে। আসলে এসব ব্যাংকের কোনো আয়-ই হয়নি। বরং ঘরের থালাবাসন বেচে কোরমা-পোলাও খাচ্ছে এসব ব্যাংক। আমানতের অর্থ লুটে খাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী। সরকারের সহযোগিতায় তারা পুষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কারণেই এখন আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। 

আহসান এইচ মনসুর বলেন, চাকরির ভয় পেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকলে আর্থিক খাত ঠিক হবে না। আর্থিক খাতে ভঙ্গুরতার পরিণতি জনগণকে ভোগ করতে হয়। যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাকরি করেন, তাদের কিছু হয় না। এ জন্য আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। না হলে খাতটি আরও খারাপ হয়ে পড়বে। সরকারকে এই বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করতে হবে।

ইআরএফের পক্ষ থেকে উপস্থাপনা করা মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ডলার সংকট ও ব্যাংক খাতে দুরবস্থার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। সরকারের সব অর্জন যেন এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক খাতের দুরবস্থা ম্লান করে দিচ্ছে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে কঠোর নীতির পরিবর্তে একের পর এক নীতি সহায়তার নামে ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারীদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কাজে ব্যর্থ হয়েছে। আর যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই এখন অস্বস্তিতে আছে। 

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, এমন পরিস্থিতিতে তথ্য প্রকাশ সীমিত করে ফেলার পাশাপাশি সাংবাদিকদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রবেশ বন্ধ করা হয়েছে। আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা কেউ জানতে পারছে না। ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল­াহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।