ইউরোপের গ্যাস আতঙ্ক

২০১০-এর দশকের শুরুতে ইউরো সংকট ও ২০১৫ সালের অভিবাসী সংকট উল্লেখযোগ্য

 ইউরোপের গ্যাস আতঙ্ক
ইউরোপের গ্যাস আতঙ্ক-প্রথম নিউজ

প্রথম নিউজ, ডেস্ক : আপনি যদি গত কয়েকদিন ভূমধ্যসাগরের কোনো সৈকতে অথবা বার্লিন, লন্ডন, রোমের উত্তপ্ত রাস্তায় ঘোরেন, তাহলে সবশেষ যে বিষয়টি মাথায় আসার কথা তা হলো- ঠাণ্ডা আবহাওয়া। তবে ভুল করবেন না- শীত আসছে। আর তা ইউরোপীয়দের জন্য মারাত্মক ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে কেবল জ্বালানি সংকটের কারণে। গত কয়েক দশকে বেশ কয়েকটি বিপর্যয় ইউরোপকে প্রায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল, যার মধ্যে ২০১০-এর দশকের শুরুতে ইউরো সংকট ও ২০১৫ সালের অভিবাসী সংকট উল্লেখযোগ্য। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে ২০২২ সালের শীতকালীন জ্বালানি সংকট। এতে আরও একবার চরম পরীক্ষা দিতে হবে ইউরোপের ঐক্যকে।

বেশিরভাগ ইউরোপীয় এই ‘গ্যাস্টাস্ট্রোফি’ চোখে দেখতে পারবেন না। তবে বাজারগুলোতে সতর্ক সংকেত এরই মধ্যে লাল হতে শুরু করেছে। আসন্ন শীতে সরবরাহের জন্য প্রতি মেগাওয়াট/ঘণ্টা গ্যাসের দাম ১৮২ ইউরোতে পৌঁছেছে, যা গত মার্চের শুরুর দিকের তুলনায় প্রায় সমান এবং তাদের দীর্ঘমেয়াদী মাত্রার প্রায় সাতগুণ বেশি।

ফ্রান্স-জার্মানির সরকারগুলো এরই মধ্যে ইউলিটিগুলোর জন্য অর্থনৈতিক প্রণোদনার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। রেশনিং ব্যবস্থা চালু হলে সবার আগে কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ধাক্কা খাবে, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন বিনিয়োগকারীরা। এমনকি যুদ্ধ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে পরিচিত জ্বালানি ব্যবসায়ীরাও এখন উদ্বিগ্ন।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরুর পর থেকেই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে গুরুতর জ্বালানি সংকট। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও রাশিয়ার ব্লাকমেইলে হুমকির মুখে পড়েছে ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ। এ মহাদেশের জ্বালানি চাহিদার এক চতুর্থাংশ পূরণ হয় গ্যাস দিয়ে, যার এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে রাশিয়া। জার্মানির মতো কিছু দেশে এর হার আরও বেশি।

তেল-কয়লার বাণিজ্য যেমন বৈশ্বিক ও সহজ, গ্যাসের ক্ষেত্রে তেমনটি নয়। এটি হয় পাইপ দিয়ে অথবা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আকারে পরিবহন করতে হয়। আর তাতে যেসব স্থাপনার দরকার হয়, সেগুলো তৈরি বা পুনর্সজ্জিত করতে কয়েক বছর লেগে যায়। ভ্লাদিমির পুতিন এগুলো ভালোভাবেই জানেন। তাছাড়া গ্যাস এমন একটি বাজার, যেখানে সুবিধাজনক অবস্থান রাশিয়ারই।

তেল রপ্তানি করতে না পারলে রুশ অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। পাঁচ বছর ধরে দেশটির জিডিপিতে প্রায় ১০ শতাংশ অবদান রাখছে তেল। তবে তাদের গ্যাসের বাজার অত বড় নয়, জিডিপিতে এর অবদান মাত্র দুই শতাংশের মতো। অর্থাৎ গ্যাস রপ্তানি না করেও টিকে থাকতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই পুতিন হয়তো ভাবছেন, পাইপলাইনের ট্যাপ বন্ধ করলে নিজেদের যতটা ক্ষতি হবে, তার চেয়ে বেশি আঘাত দিতে পারবেন ইউরোপকে।

আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্ত থেকে এলএনজির অতিরিক্ত চালান পাওয়ায় কয়েক সপ্তাহ আগে মনে হচ্ছিল, ইউরোপ হয়তো বড় সংকট এড়াতে চলেছে। তবে সেই পরিস্থিতি হঠাৎ আবারও খারাপ হচ্ছে। এর পেছনে নরওয়ের একটি গ্যাসফিল্ডের সমস্যা ও উত্তপ্ত আবহাওয়াকে আংশিক দায়ী করা যায়। তবে বড় কারণ- রাশিয়ার গ্যাজপ্রম ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে এর হার অর্ধেক ছিল আগে থেকেই, এখন তা আরও কমে গেছে।

রাশিয়া বলছে, গত ১১ জুলাই থেকে নর্ড স্ট্রিম ১ পাইপলাইনের সংস্কার কাজ চলছে আর তা শেষ হবে ২২ জুলাই। তবে দেশটি বিকল্প পাইপলাইনগুলো দিয়ে সরবরাহ বাড়িয়ে ক্ষতি পূরণের কোনো চেষ্টাই করেনি। এ কারণে ব্যবসায়ীদের ধারণা, পুতিন ইচ্ছা করেই ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন।

ইউরোপীয় ভোক্তাদের ওপর কী বিপদ ঘনিয়ে আসছে সে বিষয়ে তাদের ধারণা হয়তো খুব কম। এই মুহূর্তে তাদের অনেকেই মূল্যসীমা, ভতুর্কি, দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির সুবিধা ভোগ করছেন। সাধারণ জার্মানরা গ্যাসের জন্য বাজারমূল্যের মাত্র ৭০ শতাংশ দাম দিয়ে থাকেন। সমস্যায় রয়েছেন শিল্পগ্রাহকরাও। ইউবিএস ব্যাংকের মতে, রুশ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে গোটা ইউরো জোনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৪ শতাংশ পয়েন্ট কমে যেতে পারে এবং মূল্যস্ফীতি ২ দশমিক ৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে জার্মানির অবস্থা হবে আরও খারাপ।

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় ইউরোপের জিডিপি ছয় শতাংশ কমে গিয়েছিল। তবে জ্বালানি হুমকি আরও ভয়ংকর। গ্যাসের ঘাটতিতে ‘বেগার দাই নেইবর’ (আপন স্বার্থরক্ষায় এমন পদক্ষেপ নেওয়া যাতে প্রতিবেশী দেশের ক্ষতি হতে পারে) আচরণ শুরু হতে পারে। কেউ কেউ নিজস্ব মজুত বাড়াতে অন্য দেশগুলোতে সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্যাসের খুচরা দামের ভিন্নতার কারণে একক বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। তাদের সরকারি দেনা এখনই যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। একটি মূল্যস্ফীতিসম্পর্কিত ধাক্কা খেলাপি হওয়ার ভয়, এমনকি ইতালীয় ঋণ সংকটের আশঙ্কাও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা গোটা ইউরো অঞ্চলকে হুমকির মুখে ফেলে দেবে।

এসব কারণে ইউরোপীয় সরকারগুলোকে এখনই জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। টিকার মতো গ্যাসের জন্যেও জাতীয় বিভাগ গঠন করতে হবে। আগামী ২৬ জুলাই জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে ইউরোপীয় কমিশন। গ্যাস বাণিজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ পরিকল্পনায় ব্রিটেন ও নরওয়েকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সরবরাহ সর্বাধিক হওয়া দরকার, এ জন্য নেদারল্যান্ডসকে তার গ্রোনিংজেন গ্যাসফিল্ড আগামী বছর বন্ধ করার পরিকল্পনা স্থগিত করতে হবে।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom