আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস: ‘মনে হয় ছেলে ফিরে আসবে’

২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার সাভার থেকে ডিবি ও র‌্যাবের পরিচয়ে বাস থেকে তুলে নেওয়া হয় আল মুকাদ্দাসকে। সেই থেকে নিখোঁজ তিনি।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস: ‘মনে হয় ছেলে ফিরে আসবে’

প্রথম নিউজ, পিরোজপুর: পিরোজপুর সদর উপজেলার খানাকুনিয়ারি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসাশিক্ষক আবদুল হালিম ও আয়শা সিদ্দিকা দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে আল মুকাদ্দাস পড়ালেখার পাশাপাশি মঞ্চনাটক করতেন। লিখতেন কবিতা। করতেন ভালো আবৃত্তি। মুকাদ্দাসকে নিয়ে মায়ের অনেক আশা। ছেলে একদিন ব্যারিস্টার হবেন। সংসারের হাল ধরবেন। একটি গুমের ঘটনা সেই স্বপ্নে যতিচিহ্ন পড়ে।

২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার সাভার থেকে ডিবি ও র‌্যাবের পরিচয়ে বাস থেকে তুলে নেওয়া হয় আল মুকাদ্দাসকে (২৪)। সেই থেকে এখনো নিখোঁজ কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুকাদ্দাস। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারকে গুমের শিকার হওয়া ৭৬ জনের তালিকা দেয়। ওই তালিকায় আল মুকাদ্দাসের নাম আছে।

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। এ উপলক্ষে গুম হওয়া মুকাদ্দাসের মা আয়শা সিদ্দিকার (৫৬) সঙ্গে কথা হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার তিন সন্তানের মধ্যে মুকাদ্দাস সবার চেয়ে মেধাবী ছিল। ছেলেটি পড়াশোনার জন্য ১৩ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়ে। এরপর বন্ধে বাড়িতে আসত। বাড়িতে এসে বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশীদের নিয়ে মেতে থাকত। প্রতিবছর ঈদের পরদিন আমাদের বাড়ির পাশের মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত মুকাদ্দাস। সেখানে নিজে মঞ্চনাটকে অভিনয় করত।

ছেলেটি পড়াশোনার জন্য ১৩ বছর বয়সে বাড়ি ছাড়ে। এরপর বন্ধে বাড়িতে আসত। বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশীদের নিয়ে মেতে থাকত। আয়শা সিদ্দিকা জানান, মুকাদ্দাস অষ্টম শ্রেণিতে নেছারাবাদ উপজেলার ছারছিনা দারুসসুন্নাত আলিয়া কামিল মাদ্রাসায় পড়ার জন্য ভর্তি হয়। সেখান থেকে দাখিল ও ঢাকার তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা থেকে বিজ্ঞান বিভাগে আলিম পাস করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকাহ ও আইন বিভাগে ভর্তি হন। তিনি আরও বলেন, ‘ছেলে যখন মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করত, তখন অপেক্ষায় থাকতাম ছুটিতে ছেলে বাড়ি আসার। তেমনি ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পরও ১০ বছর ধরে ছেলের ফেরার অপেক্ষায় থাকি। প্রতিদিনই মনে হয়, ছেলে ফিরে আসবে। বিশেষ করে যখন শুনি নিখোঁজ কোনো ব্যক্তি বাড়ি ফিরেছেন বা উদ্ধার হয়েছেন, তখন আমার মনে আশা জাগে, হয়তো একদিন মুকাদ্দাস ফিরে আসবে।’

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে আল মুকাদ্দাস ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার ওয়ালিউল্লাহ রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকা থেকে হানিফ পরিবহনের বাসে ওঠেন। ওই রাতে বাসটি সাভারের নবীনগর এলাকায় পৌঁছালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কয়েকজন বাস থেকে আল মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে নামিয়ে নিয়ে যান। মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে না ফেরায় তাঁদের বন্ধুরা পরিবারকে জানান। খোঁজাখুঁজির পরও তাঁদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ওই বাসের সুপারভাইজার মো. সুমন নিখোঁজ ছাত্রদের পরিবারকে জানিয়ে ছিলেন, ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টার দিকে সাভারের নবীনগর এলাকায় বাস থামিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কয়েকজন তাঁদের বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যান।

এ ঘটনায় ৬ ফেব্রুয়ারি মুকাদ্দাসের নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর চাচা আবদুল হাই রাজধানীর দারুসসালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি ওয়ালিউল্লাহর নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর বড় ভাই খালেদ সাইফুল্লাহ আশুলিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর নিখোঁজ দুই ছাত্রের পরিবার পুলিশ, র‌্যাবসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েও সন্ধান না পেয়ে হাইকোর্টে দুটি বন্দী প্রদর্শন রিট পিটিশন করেন। তবে মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ নিখোঁজের ব্যাপারে আদালতকে কোনো সন্ধান দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন। এরপর আদালত কয়েকটি পর্যবেক্ষণসহ রিটটি খারিজ করে দেন।

মুকাদ্দাসের বাবা ৬৩ বছর বয়সী আবদুল হালিম বলেন, পাঁচ বছর বয়সে খানাকুনিয়ারি পোরগোলা একপাই রব্বানিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আল মুকাদ্দাসকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন (আবদুল হালিম) ওই মাদ্রাসার শিক্ষক। প্রতিদিন সকালে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মাদ্রাসায় যেতেন। বর্তমানে তিনি শিক্ষকতার জীবন শেষ করে অবসরজীবন কাটাচ্ছেন।

আল মুকাদ্দাসকে চিনতেন পিরোজপুর সদর উপজেলার কদমতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. হানিফ খান। তিনি বলেন, ছেলেটির বিরুদ্ধে এলাকায় কখনো কোনো অভিযোগ ছিল না। শুনেছেন, ১০ বছর ধরে ছেলেটি নিখোঁজ। মা আয়শা সিদ্দিকা বলেন, ‘মুকাদ্দাসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছা ছিল যুক্তরাজ্য থেকে বার অ্যাট ল শেষ করে দেশে ফিরে ব্যারিস্টার হিসেবে হাইকোর্টে আইন পেশায় যুক্ত হওয়ার।

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom