সঞ্চয়পত্র ভাঙার হিড়িক, সুদাসল মেটাতেই বাড়তি চাপ
সঞ্চয়পত্র ভেঙে লাভ হচ্ছে না লোকসান হচ্ছে সেদিকে তাকানোর সময় কই, আগে বাঁচতে হবে।’
প্রথম নিউজ, ঢাকা: শফিউল্লাহ সিকদার পেশায় পোশাক ব্যবসায়ী। থাকেন রাজধানীর মগবাজারে। স্ত্রী আর দুই মেয়ে নিয়ে ভাড়া বাসায় সংসার তার। বড় মেয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত, ছোট মেয়ে পড়ছে নবম শ্রেণিতে। নিজের আয় দিয়ে দুই মেয়ের পড়া-লেখা ও সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এবার ঈদে ব্যবসাও ভালো হয়নি। তাই পাঁচ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র মেয়াদ পূর্তির আগেই ভেঙে ফেলেছেন। শফিউল্লাহ বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের কারণে সন্তানের পড়াশোনা দূরের কথা, ঢাকায় থাকতে পারবো কি না জানি না। আগামী ঈদে বেচা-বিক্রি না হলে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। চলে যেতে হবে গ্রামের বাড়ি। এখন সঞ্চয়পত্র ভেঙে লাভ হচ্ছে না লোকসান হচ্ছে সেদিকে তাকানোর সময় কই, আগে বাঁচতে হবে।’
একই কথা বলেন পুরান ঢাকার আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের সংসার। ভালোই যাচ্ছিল দিন। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে টাকায় টান পড়েছে। জমানো টাকায় সব খরচ মিটবে না, তাই সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা ছিল, এখন বিক্রি করে দিতে হবে। এর আগে দুই লাখ টাকা খরচ করে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলাম। মেয়ের বিয়ের জন্য কমিউনিটি সেন্টার পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা চাচ্ছে। কমিউনিটি সেন্টার থেকে বলা হচ্ছে সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি দিতে হবে। আমার জমানো দেড়-দুই লাখ ছিল সেটা দিয়ে হচ্ছে না, তাই সঞ্চয়পত্র ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে এভাবে জীবনযাত্রার মান ব্যাহত হচ্ছে সাধারণ মানুষের। বেশি বিপাকে পড়ছেন সীমিত আয়ের মানুষ। সার্বিকভাবে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। শহরে এ হার বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তবে গ্রামে ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত এক দশকের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এতে কমছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। বেশিরভাগই ভোগ কমিয়ে হাতের বাড়তি টাকা দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছেন। আর এসব কারণে কমেছে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ।
হাবিবুর রহমানের শেয়ার বাজারে প্রায় সাত লক্ষাধিক টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। বাজারের পতন ঠেকাতে গত জুলাইয়ে শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস (দরপতনের সর্বনিম্ন সীমা) বেঁধে দেয় বিএসইসি। ফলে শেয়ারদর নির্দিষ্ট একটি সীমায় আটকে যায়। এতে জরুরি প্রয়োজন হলেও অনেকে শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। হাবিব জানান, এখন টাকা তুলতে না পারায় সংসারের খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে বেশ বিপাকে তিনি। সংসার চালাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করবেন। গত জুন মাসে পাঁচ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, মেয়াদ পূর্তির আগেই বিক্রি করতে হচ্ছে।
সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকরা বলছেন, একসময় মধ্যবিত্ত পরিবারের আস্থার জায়গা ছিল সঞ্চয়পত্র। চাকরি থেকে অবসরের পর পাওয়া অর্থ বা বাড়তি টাকা থাকলে সেগুলো সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতেন। এখন সঞ্চয়পত্রে কিছুটা কড়াকড়ি রয়েছে। সরকার সুদহারও কমিয়েছে। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নেমেছে ধস।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে। এসময়ে বিক্রির পরিমাণ এত তলানিতে যে, বিক্রির টাকা দিয়ে গ্রাহকদের আগে বিনিয়োগ করা সঞ্চয়পত্রের সুদাসল পরিশোধ করাও সম্ভব হয়নি। এই ৯ মাসে ৬২ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আর সরকার এ খাতে মোট পরিশোধ করেছে ৬৬ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ, নয় মাসে আরও চার হাজার ১৬১ কোটি টাকা সরকারি কোষাগার বা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে।
গত মার্চ মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ছয় হাজার ৭৯৫ কোটি টাকার। তবে সরকারকে মূল ও মুনাফা বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে সাত হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে পরিশোধ হয়েছে ৬৫২ কোটি টাকার বেশি। গত বছরের একই সময়ে (২০২২ সালের মার্চ) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। এ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রথম ছয় মাসে এ খাত থেকে কোনো ঋণ পায়নি।
চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৫০ হাজার ৩৮০ কোটি টাকার বেশি এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। উক্ত সময়ে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরেও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বড় অংকের ঋণ ছিল। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সরকারের ব্যাংকঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয় ১০ শতাংশ। সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন সনদ বাধ্যতামূলক, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্তসহ বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়। এরপরও বিক্রি বাড়ছিল। তবে সবশেষ ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়। এরপরই ভাটা পড়তে থাকে বিক্রিতে।
সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না পাওয়ায় ব্যাংকমুখী হয়েছে সরকার। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে এক লাখ ছয় হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। আগের অর্থবছরে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে।
ধারবাহিকভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কেন কমছে এ বিষয়ে কথা হয় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরে সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কয়েকটি কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ। এর মধ্যে রয়েছে শর্তারোপ করা। এখন পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে আয়কর রিটার্নের স্লিপ জমা দিতে হয়। এতে অনেকেই এ ঝামেলায় যেতে চাচ্ছেন না। আবার মানুষের হাতে এখন টাকা কমেছে। সংসার চালাতে তারা সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছেন। আবার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে, এটাও একটি কারণ। এসব কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।