শ্রাবণের ‘খরায়’ পুড়ছে কৃষকের কপাল

#সেচ বাবদ বাড়তি খরচ হবে প্রায় ২৩৩ কোটি # বীজতলাও তৈরি করতে পারেননি অনেক কৃষক # বিলম্বে রোপণে ফসলে রোগবালাইয়ের আক্রমণ ও ফলন কমার আশঙ্কা

শ্রাবণের ‘খরায়’ পুড়ছে কৃষকের কপাল

প্রথম নিউজ, বগুড়া: বর্ষার ভরা মৌসুমেও কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির দেখা নেই। শ্যালো মেশিন চালিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে আমন ধানের চারা লাগাচ্ছেন কৃষকরা। এতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। সেইসঙ্গে আমন চাষাবাদ নিয়ে নানামুখী শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ চিত্র বগুড়াসহ উত্তরের বেশ কয়েকটি জেলায় এখন। স্বাভাবিক কারণেই বোরোতে লোকসানের পর এবার আমনেও লোকসানে পড়তে যাচ্ছে কৃষক।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যেসব জেলা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নওগাঁ। গত কয়েক বছর নওগাঁয় ঠিকমতো মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয় না। যার প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন ফসলে 

এমন পরিস্থিতিতে এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে ব্যয় কেমন হতে পারে জানতে চাইলে শেরপুর উপজেলার সাধুবাড়ী গ্রামের কৃষক গোলাম রব্বানী ও মাহবুবুর রহমান জানান, জমি প্রস্তুতির জন্য হালচাষ বাবদ স্বাভাবিক সময় ব্যয় হয় ২০০০ টাকা। এখন বৈরী আবহাওয়ার কারণে জমি প্রস্তুত করতে হালচাষ বাবদ অতিরিক্ত ৫০০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। আমন চাষে কোনো সেচ খরচ করতে হয় না। কিন্তু এখন বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টির দেখা নেই। এবার বোরো মৌসুমের মতোই সেচ দিয়ে আমনের চারা রোপণ করতে হচ্ছে। এতে সেচ বাবদ ২০০০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে এবার প্রতি বিঘা জমিতে আমন চাষে বাড়তি ২৫০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে।

বিঘাপ্রতি জমি রোপণের খরচের বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও বলেন, জমি চাষকালে টিএসপি ১০ কেজি ৩০০ টাকা, এমওপি (পটাশ) ১০ কেজি ৩০০ টাকা, ইউরিয়া ৫ কেজি ১৫০ টাকা, জিপসাম ১০ কেজি ১৫০ টাকা, দস্তা ১ কেজি ২০০ টাকা, সালফার ৩ কেজি ১২০ টাকা ও ম্যাগনেশিয়াম সার ২ কেজি ৮০ টাকা খরচ করে জমিতে ছিটাতে হচ্ছে। এরপর জমির আইল কাটা বাবদ শ্রমিক ব্যয় ২০০ টাকা, ধানের চারা রোপণ বাবদ ১২০০, আগাছা প্রতিরোধে কিটনাশক ও ইউরিয়া ৫ কেজি বাবদ ১৫০, জমি নিড়ানী বাবদ শ্রমিকের ৫০০ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় যোগ হবে।

এছাড়া গাছ বাড়ন্ত হলে দ্বিতীয় দফায় আবার ইউরিয়া সার ১০ কেজি ৩০০ টাকা, এমওপি (পটাশ) ৫ কেজি ১৫০ ও ড্যাপ সার ৫ কেজি ১২০, প্রয়োজন অনুযায়ী কিটনাশক ব্যয় ১৫০০, ধান কাটা ও মাড়াই করা বাবদ ৪০০০ এবং বীজ ও বীজতলা তৈরি বাবদ ১০০০ টাকা ব্যয় করতে হবে কৃষককে। যেসব কৃষকের নিজের জমি নেই তাদের (বর্গাচাষি) জন্য অতিরিক্ত আরও ৭০০০ টাকা জমি লিজ নেওয়া বাবদ ব্যয় করতে হবে। সব মিলিয়ে আমন মৌসুমের শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। লোকসান গুনতে হবে চাষিদের।

গাবতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, এবার খরার কবলে পড়ে আমন চাষাবাদ ব্যাহত হতে চলেছে। বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকদের বাড়তি সেচ দিয়ে আমন চাষাবাদ করতে হচ্ছে। এতে আমন চাষাবাদে লাভ এবার কম হবে।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বছর এ সময় পর্যন্ত প্রায় অর্ধেক জমিতে আমন চাষ শেষ হয়ে যায়। অথচ এবার জেলায় ১ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদ হয়েছে। এসব জমিতে চাষাবাদ হয়েছে মূলত সেচের পানি দিয়ে। জেলায় ছোট-বড় মিলে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ গভীর ও অগভীর নলকূপ প্রস্তুত করা হয়েছে। ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত এসব নলকূল চালাতে গিয়ে সেচ বাবদ প্রায় ২৩৩ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে।

বীজতলাই তৈরি হয়নি নওগাঁয়

পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান রোপণ করতে পারছেন না। অন্যদিকে বৃষ্টির অভাবে কিছু জমিতে সদ্য রোপণ করা আউশ ধানের ক্ষেত নিয়েও বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। আমন চাষিদের সেচ পাম্পের পানিই এখন একমাত্র ভরসা। এতে এ জেলার কৃষকদের আমন ধান চাষের খরচ অনেকগুণ বেড়ে গেছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যেসব জেলা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নওগাঁ। গত কয়েক বছর নওগাঁ জেলায় ঠিকমতো মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয় না। যার প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন ফসলের ওপর। প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে রোপা আমন চাষতো দূরের কথা, অনেক কৃষক এখনো বীজতলাও তৈরি করতে পারেননি।

নওগাঁ সদরের কৃষক আমজাদ আলী বলেন, আষাঢ়ের ১৫ তারিখের পর ও শ্রাবণের ১৫ তারিখের মধ্যে আমন ধানের চারা রোপণ করা হয়। এখন শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহ পার হলেও আমরা পানির অভাবে চারা লাগাতে পারছি না।

সিরাজগঞ্জের কৃষকের মাথায় হাত

চলনবিল অধ্যুষিত এ অঞ্চলে যমুনায় গত কদিনে পানি বাড়লেও চলছে তাপদাহ। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে চলনবিলে খরার হাতছানি দিচ্ছে। আমন ধানের চাষাবাদে আষাঢ়-শ্রাবণ উৎকৃষ্ট সময় হলেও প্রচণ্ড তাপদাহে শ্রমিক সংকটও প্রকট। এ কারণে ধীরগতিতে হচ্ছে আমন চাষাবাদ। সময়মতো আমনের চারা রোপণ না করায় অনেক স্থানেই বিবর্ণ হয়ে বুড়িয়ে যাচ্ছে বীজতলা।

তাড়াশের পাড়িল গ্রামের কৃষক আবদুল লতিফ জানান, প্রকৃতির পানি না পেলে কৃত্রিম সেচে আবাদের খরচ বেড়ে যায়। তাই হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন এখানকার অনেকেই।  এখনো বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সময় আছে। সেচ দিয়ে চাষ করলে কৃষকের খরচ অনেক বেড়ে যাবে’- মতলুবুর রহমান, উপ-পরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়া 

জয়পুরহাটে বেহাল অবস্থা

জেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, এ মুহূর্তে যেসব মাঠে চারদিকে পানি থইথই করার কথা সেসব মাঠ এখন দাবদাহে ফেটে চৌচির। মৃদু দাবদাহ অব্যাহত থাকায় খরায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। এখনো আমন রোপণ করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন এখানকার বেশিরভাগ চাষি। এ পরিস্থিতিতে ধান রোপণে বিলম্ব হলে রোগবালাইয়ের আক্রমণ বাড়ার পাশাপাশি ফলন কমের আশঙ্কা রয়েছে। তাই কিছু কিছু এলাকার কৃষক বাধ্য হয়ে গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে সেচের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণ করেছেন। দাবদাহ অব্যাহত থাকায় নিয়মিত ওইসব জমিতে সেচ দিতে গিয়ে বাড়তি খরচ বহনে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। সেচের অভাবে রোপণ করা অনেক জমির ধান এখন হলুদ বর্ণ ধারণ করে মরতে বসেছে। ফলে মাঠের পর মাঠ অনাবাদি পড়ে রয়েছে।

পাঁচবিবি গ্রামের কৃষক মোজাম্মেল বলেন, স্বাভাবিক বৃষ্টির দেখা মিলছে না। খাঁ খাঁ করছে ফসলি মাঠ। আমনের চারা রোপণ, আউশের ক্ষেতে সেচ, অন্যদিকে পাট জাগ দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু কোথাও পানি না থাকায় পাট চাষিদের কপালেও পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।

কর্তৃপক্ষ যা বলছে

চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে আমন আবাদ ২০ লাখ হেক্টর থেকে বাড়িয়ে ২৬ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। আমন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল, যা বার্ষিক ধান উৎপাদনের প্রায় ৪০ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-পরিচালক মতলুবুর রহমান বলেন, খরা ও কম বৃষ্টিপাত আউশ ফলনে প্রভাব ফেলেছে। এখন সেচের পানিই একমাত্র ভরসা। তবে এখনো বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সময় আছে। সেচ দিয়ে চাষ করলে কৃষকের খরচ অনেক বেড়ে যাবে।