রাজধানীতে দুর্বিষহ যানজট
ফুটপাতে আছে নিয়মিত নানা ব্যবসার দোকান। দুপুরের পর থেকে যুক্ত হয় ইফতারির পসরা। ফুটপাতে জায়গা না পেয়ে রাস্তা ধরে চলেন সাধারণ মানুষ।

প্রথম নিউজ, ডেস্ক: রাজধানীর টিটিপাড়া মোড় থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই লেভেল ক্রসিং। এখানে পদ্মা সেতু প্রকল্পের রেললাইন নির্মাণকাজ চলমান। ফলে রাস্তা সরু যেমন হয়েছে, তেমনি ভাঙাচোড়াও। এতে ব্যস্ত এই সড়কে যানবাহনের গতি কমেছে। এর একটু সামনে চলছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। এক লেন বন্ধ, অপর লেনে সড়ক বিভাজক করে চলছে দুই লেনের যানবাহন। ফুটপাতে আছে নিয়মিত নানা ব্যবসার দোকান। দুপুরের পর থেকে যুক্ত হয় ইফতারির পসরা। ফুটপাতে জায়গা না পেয়ে রাস্তা ধরে চলেন সাধারণ মানুষ। স্টেশনের কাছে শত শত রিকশা, মোটরসাইকেল অগণিত। আছে অটোরিকশা ও কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন দূরপাল্লার বাস। এখানেই শেষ নয়, সিটি সার্ভিসগুলো যাত্রী তুলতে কমলাপুর স্টেশনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই। এতে পথের ভোগান্তি অবর্ণনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।
নগরীর অন্যতম ব্যস্ত পথ পল্টন ও গুলিস্তানেও একই অবস্থা। বাসে পুরানা পল্টন মোড় থেকে জিরো পয়েন্ট হয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউসহ পুরো গুলিস্তান ছাড়াতে সর্বোচ্চ এক মিনিট সময় লাগার কথা। এখন এই এক মিনিটের পথে চলছে ঘণ্টার মহাভোগান্তি। সরেজমিন দেখা গেছে, পুরানা পল্টন মোড় থেকে উড়াল সেতুর লুপ পর্যন্ত ও আশপাশের এলাকার ফুটপাতজুড়ে কত কাপড়, জুতাসহ বাহারি পণ্যের দোকান রয়েছে, তা গুনে শেষ করা যায়নি। বাস্তবতা এই ফুটপাত ধরে হেঁটে চলার সুযোগ নেই। দখল হয়েছে ফুটপাতও। একইভাবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম গেটের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-বরিশালসহ দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়। সড়কের উভয়পাশে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শত শত বাস দাঁড়িয়ে থাকে। ঈদ সামনে রেখে যানবাহন, মানুষ, দোকান, পার্কিং থেকে শুরু করে ইফতারির পসরা বেড়ে যাওয়ায় এ পথে যানজটের ভোগান্তি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন পণ্যের গাড়ি ব্যস্ত সময়ে রাস্তার ওপর রাখা হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে মালপত্র ওঠানামা। আছে ঘোড়ার গাড়ি ও কাপ্তান বাজারের যন্ত্রণাও। সব মিলিয়ে এক মিনিটের পথে এখন ৬০ মিনিটের ভোগান্তি ছাপিয়ে যাচ্ছে। পুলিশসহ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফুটপাত ও রাস্তা নিয়মিত দখলমুক্ত না করা, অবৈধ গাড়ি পার্কিং ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ, রাস্তা কম ও অপ্রশস্ত পথ, রমজানে দ্রুত বাড়ি ফেরার প্রতিযোগিতা, কর্মঘণ্টা কমে আসা, ইচ্ছামত ইফতার বাজার বসানো, ঢাকার বাইরের বাড়তি যানবাহন, বাড়তি মানুষের চাপসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নজরদারির অভাবই নগরীতে যানজটের মূল কারণ। সামনের দিনে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বছরজুড়ে পথে নিবিড় নজরদারি হলে যানজটের ভয়াবহতা বাড়ত না বলেও মনে করেন তারা। সব মিলিয়ে যানজটের জন্য ১১টি কারণ পাওয়া গেছে।
গতকাল বুধবার বনানী থেকে ফার্মগেট হয়ে বাসে শাহবাগের উদ্দেশে রওনা করেন রতন মিয়া। দুপুর ১টায় রওনা দিয়ে তিনি গন্তব্যে পৌঁছান প্রায় ৪টায়। কালবেলাকে তিনি বলেন, মহাখালী ওভারপাস থেকে যানজট শুরু হয়। বাসটি ফার্মগেট আসার পর মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে সরু সড়কে যানবাহন একেবারেই থমকে যায়। বাংলামটর থেকে মগবাজার যেতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগার কথা জানিয়ে রাজু বলেন, গত দুই বছরে এই পথে যানজটে এমন ভোগান্তি দেখিনি। তেজগাঁও এলাকায় ট্রফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করা আরিকুল আলম সুমন বলেন, রাস্তায় যানবাহনের জটলা কমাতে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। সড়কের ক্যাপাসিটি কম। গাড়ি বেশি। তা ছাড়া গাড়িটি যে গন্তব্যে যাবে, সেদিকের সামনের রাস্তা ক্লিয়ার থাকে না। ফলে যানজট হয়। দীর্ঘ সিগন্যালে গাড়ি ও যাত্রীদের আটকে থাকতে হচ্ছে।
‘দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে উত্তরা থেকে রওনা দিই মিন্টো রোডের উদ্দেশে। বিকেল ৩টায় একটা কর্মশালায় অংশ নেওয়ার জন্য। বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটেও তেজগাঁও পাড়ি দিতে না পারায় লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। এখন ৫টা ৫৬ মিনিট, আমি মৌচাক ফ্লাইওভারের ওপর। এই লজ্জা আসলে কার?’ গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির দুর্বিষহ এই চিত্র তুলে ধরে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
ঢাকায় যানজট নিরসনের দায়িত্বে রয়েছে মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। তাই যানজটের কারণ জানতে চাওয়া হয় ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার কাছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, রমজানে অফিসের সময় এগিয়ে আসায় দ্রুত বাসায় ফেরার প্রতিযোগিতা, ঈদের কেনাকাটা, সর্বোচ্চ সংখ্যক যানবাহনের চাপ, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে প্রতিবছর রোজায় যানজটের ভোগান্তি একটা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, রমজান মাসে অফিসের সময় কমে যাওয়ায় পুরো ১২ ঘণ্টার চাপ এখন ৮ ঘণ্টায় ঠেকেছে। ঈদ পর্যন্ত হয়তো রাস্তার ভোগান্তি আরও বাড়বে। এখন দ্রুত অফিস ছুটি হলে সবাই বাসায় ফেরার প্রতিযোগিতায় নামে। তা ছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে আসা লোকজন দ্রুত সময়ে আবারও গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। ফলে রাস্তায় চাপ বাড়ে। একপর্যায়ে যানজট দেখা দেয়। আমরা চেষ্টা করছি যত সম্ভব মানুষের ভোগান্তি কমাতে।
যানজট প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, রমজানে কর্মঘণ্টা সংক্ষিপ্ত হয়। এর সঙ্গে ঈদকেন্দ্রিক শপিং ট্রিপ বেড়ে যায়। সারা বছর মানুষ যত কেনাকাটা করে, দুই ঈদে এর চেয়ে বেশি করে। এতে সড়কে চাপ বাড়ে। তবে এ বিষয়টি খুবই প্রত্যাশিত। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) করিডোর ছাড়া ঢাকার সবকটি প্রবেশমুখে কোনো যানজট না থাকার কথা জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) সবুজ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, রাজধানীর প্রবেশ মুখের রাস্তা বেশ প্রশস্ত। কিন্তু বাড়তি যানবাহনের চাপ পড়লে তো যানজট হওয়া অস্বাভাবিক নয়। রাজধানীর ভেতরে যানজট অন্য কারণে।
ঈদযাত্রার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এক দিনে যদি ৪০ লাখ মানুষ বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে পথে যানজট ঠেকানো যাবে না। কারণ আমাদের সড়কের ডিজাইন এত মানুষের জন্য নয়। তিনি বলেন, ঈদযাত্রা উপলক্ষে ঢাকা থেকে বের হয়ে সওজের সড়কে ইন্টারসেকশনগুলো এখনো ফ্রি হয়নি। যানজটের মধ্যমেয়াদি সমস্যা সমাধানে ইন্টারসেকশনের কাজগুলো শেষ হতে আরও ছয় মাস সময় লাগবে। চন্দ্রাতে উড়াল সড়ক হলেও রাস্তা ফ্রি রাখতে আরও কিছু কাজ করার প্রয়োজন ছিল বলে জানান তিনি।