বিএনপির ফ্যাসিবাদবিরোধী অনবদ্য ভূমিকার  যথাযথ মূল্যায়ন করেনি দেশের গণমাধ্যম

বিএনপির ফ্যাসিবাদবিরোধী অনবদ্য ভূমিকার  যথাযথ মূল্যায়ন করেনি দেশের গণমাধ্যম

প্রথম নিউজ, অনলাইন: আজকে ঘাটে ঘাটে জনে জনে বিএনপিকে কেন এতো জবাবদিহি করতে হচ্ছে যে, বিএনপি আসলে কিছুই করতে পারেনি বা করেনি এই স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে সরাতে। বিশেষ করে কতিপয় নব্য ছাত্রনেতা এটা বেশি বলছে। কারণ তারা জানে একটি মিথ্যা বারবার বললে সত্য মনে হয় মানুষের কাছে, যেটা ছিল হিটলারের প্রপাগাণ্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস থেকে ধার করা। তিনি বলেছিলেন, একটি মিথ্যা ১০০ বার বললে সেটা সত্য হয়ে যায় বা মানুষ সেটাকেই সত্য মনে করে।

এখন এখানে কতিপয় ছাত্রনেতা যারা সদ্য ভূমিষ্ঠ এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা। তারা এই ফর্মুলা হাতে নিয়েছেন। বিএনপি কি করেছে, বিএনপি একটি বালুর ট্রাক সরাতে পারেনি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা তাদের নেত্রীকে মুক্ত করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই গোয়েবলসীয় ফর্মুলা নেয়ার কারণ হলো এই ছাত্রদের অনেকের আবার আওয়ামী কানেকশন ছিল। সুতরাং আওয়ামী লীগ থেকে কিছু না কিছু তো পাবেই বা নেবেই এটাই স্বাভাবিক। খেয়াল করলে দেখবেন এদের কথার সাথে শেখ হাসিনার কথার মিল পাবেন। শেখ হাসিনা বলতো, বিএনপি বাংলাদেশের জন্য কিছুই করেনি। এরা শুধু করেছে লুটপাট আর আওয়ামী লীগ করেছে উন্নয়ন আর উন্নয়ন। বিএনপির আন্দোলন করা নিয়েও কটাক্ষ করতো হাসিনাসহ গোটা আওয়ামী লীগ। ঠিক কতিপয় ছাত্রনেতার সুরও বিএনপির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মতোই। ছাত্রনেতারা কোরাস করছে,  আন্দোলনে বিএনপি কিছুই করেনি। সব আমরা করেছি। আর এখন বিএনপি করতেছে চাঁদাবাজি আর লুটপাট। এভাবেই কিন্তু বলতেছে। ওদিকে তাদের এক উপদেষ্টার এপিএস অপসারিত হলো, দুদকের তদন্তও চালু হলো। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এই অবস্থা। এটা নিয়ে তাদের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। ঠিক শেখ হাসিনাও এমনটাই করতো। নিজের দল ও পরিবার মিলে দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছিলো গত ১৫ বছর,  আর মুখে বলতো বিএনপি করছে শুধু  লুটপাট, আর আমরা এদেশে গণতন্ত্র কায়েম করেছি। মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার  প্রতিষ্ঠা করেছি। মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করেছি। দেশের উন্নয়ন করেছি ইত্যাদি। এই লেডি গোয়েবলসকেই বক্তব্যে অনুসরণ করছে কতিপয় ছাত্রনেতা। তাদের প্রধান এবং একমাত্র এলার্জি বিএনপি। জাতীয় বেইমান জাতীয় পার্টিও নয় আবার রঙিন জামায়াতে ইসলামীও নয়। সবাই ভালো শুধু একরঙা বিএনপি খারাপ। এ যেন ঠিক লেডি গোয়েবলস ও তার দল আওয়ামী লীগের কার্বন কপি।

এবার আসি এর কারণ কি। কেন বিএনপিকে নিয়ে এরা এতো সাহস দেখাচ্ছে বা টানাহেঁচড়া করছে। তার প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশের গণমাধ্যম লীগ। এই গণমাধ্যম লীগ গত ১৫ বছর তো নয়ই, বলতে গেলে কখনোই বিএনপির ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ বা সঠিক সাংবাদিকতা করেনি। এর সদা সর্বদা আওয়ামী লীগকে ফেবার করছে এবং তা করতে গিয়ে রাজনীতির মাঠে বিএনপির বারোটা বাজিয়েছে।

সেটা কিভাবে? সেটা হলো গত ১৫ বছরকেই যদি স্ট্যান্ডার্ড ধরি তাহলে দেখবেন, এ সময় বিএনপির ওপর হাজারো রকমের অত্যাচার হয়েছে, লাখ লাখ মামলা হয়েছে, হাজার হাজার কর্মীরা গুম-খুনের শিকার হয়েছে। হাজার হাজার কর্মী বছরের পর বছর জেল খেটেছে। সচ্ছল তৃণমূল নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে। এক যুগের বেশি শত শত তৃণমূল নেতাকর্মী ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। ছেলে বিএনপি করে তাকে ধরতে এসে না পেয়ে বাপকে হত্যা করে ফেলেছে। কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর! এই ঘটনায় দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় তোলপাড় হয়ে যাওয়ার কথা। হয়েছে কিছু! হয়নি। কারণ ওই যে একদিকে বিএনপির মিডিয়া অজ্ঞতা আর সেই সুযোগে আওয়ামী মিডিয়ার এসব লুকিয়ে ফেলা। খেয়াল করলে দেখবেন টেকনাফের যুবলীগ নেতা একরামের ক্রসফায়ারের হত্যা নিয়ে সে কী তোলপাড়। দেশের সব আওয়ামী মিডিয়া এবং তাদের পাঠানো রিপোর্টে বিদেশি মিডিয়াতেও এই ক্রসফায়ার নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।  অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে শুরু করে   জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বিএনপি নেতাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আপনারা জানেন কি, বিদেশি নামি-দামি সব সংবাদমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিনিধিগুলোর প্রায় সবগুলোই আওয়ামীপন্থী সাংবাদিকদের দখলে। সুতরাং খিলগাঁও থানা ছাত্রদল সেক্রেটারি জনিকে জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর আবার তুলে নিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাক কয়েক রাউন্ড গুলি করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী হত্যা করে ফেললে সেটা অতোদূর যায় না। তারা যেতে দেয় না। একরামের মেয়েরা যেমন এতিম হয়েছে। জনির বাবার মুখ না দেখা সন্তানও এতিম হয়েছে। তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত ছাত্রদল সভাপতি জাকিরকেও প্রেসক্লাবের মানববন্ধনের পর তুলে নিয়ে হত্যা করেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। তার মেয়েরাও এতিম হয়েছে। সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এরকম ডজনে ডজনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আছে তার কোনো হদিস মিডিয়াতে। নেই। প্রেসক্লাবে সাদা পোশাকে প্রকাশ্যে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে কিভাবে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায় ৬ মার্চ, ২০১৮ সালে স্বেচ্ছাসেবক দল সভাপতি শফিউল বারী বাবুকে। এই মিডিয়া কী একটা ফলোআপ করছে সেই পুলিশ কারা এবং কোথায় আছে এখন। না করেনি। বরং এগুলো দেশে এবং বিদেশে চাপা দিয়ে দেয় এই আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক লীগ। বিএনপিতে এসব নিয়ে গভীরে যাওয়ার মতো মিডিয়া বিশেষজ্ঞ আছে কি?

১২ বছর পর বাড়ি এসে এই ইন্টারিম আমলে খুনের শিকার হয়েছে এরকম একাধিক ঘটনা ঘটেছে বিএনপির বেলায়। কুমিল্লায় একটা জিডিও নেই এরকম যুবদল নেতাকে যৌথ বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। তারপর আর জীবিত পাওয়া যায়নি। পুরো গ্রামবাসী এটার প্রতিবাদ করেছে। ইন্টেরিম আমলেও বিএনপির এক ডজনেরও বেশি নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এসব নিয়ে কারো কোনো উচ্চবাচ্য নেই। কেন এখনো হত্যার শিকার হচ্ছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। না বিএনপি,  না মিডিয়া না নতুন ছাত্রনেতারা কেউ এটা নিয়ে জোরালোভাবে প্রশ্ন তুলছেন না। ফলে এখনো চাপা পড়ে যাচ্ছে বিএনপির লোকজনের ওপর সংঘটিত নির্যাতন বা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। 

এভাবেই মিডিয়া বিএনপির ওপর বৈরী আচরণ করে। ফলে হারিয়ে যায় বিএনপির ন্যায্য অনেক আলোচনা। পক্ষান্তরে মিডিয়া সামনে নিয়ে আসে তাদের অন্য এজেন্ডা। এমনি করে গত ১৫ বছরে বিএনপির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নির্যাতনের স্টিম রোলারও মিডিয়া লীগ কর্তৃক চাপা দিয়ে দেয়ায় আজকে এসব ছাত্রনেতা বলতে সাহস পায় কী করেছে বিএনপি। বিএনপি তো কিছুই করতে পারেনি এই সরকারকে হটাতে। এজন্য অবশ্য বিএনপির অনেক দায় আছে।  কিছুদিন আগে মারা যাওয়া প্রফেসর আরেফিন সিদ্দিক ছিলেন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অঘোষিত পীর। তার ছাত্র এবং তার ছাত্র নয় কিন্তু গণমাধ্যমে আছে এরকম প্রায় সবাই আরেফিন সিদ্দিককে গুরু মানে।  আরেফিন সিদ্দিক একাধারে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক, নেতা, সাবেক ভিসি এবং বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পড়া বা না পড়া প্রায় সবার পূজনীয় শিক্ষক ও নির্দেশক ছিলেন। এরকম আরও অনেক মিডিয়া বিশেষজ্ঞ আছেন যারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ ঘরানার। আর বিএনপিতে আরেফিন সিদ্দিক মানের মিডিয়া বিশেষজ্ঞ বা বিএনপিপন্থী এরকম কেউ আছেন কি না। এই তুলনাটা বিএনপি করুক। দল হিসেবে মিডিয়া সচেতন হোক। রাজনীতিক নয় পেশাদার দলীয় লোক দিয়ে মিডিয়া সেল সাজাক এটাই কাম্য। তা হলে এদেশের আওয়ামী মিডিয়া এতোটা ফাঁকি দিতে পারবে না বিএনপিকে।

মাহবুব জামান, ফ্রিলান্সার
amikewna79@gmail.com