মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোয় মানবাধিকার গোষ্ঠীর তীব্র সমালোচনার মুখে হোয়াইট হাউস

হাফপোস্টের খবরে বলা হয়, ভারত সরকার এই সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।

মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোয় মানবাধিকার গোষ্ঠীর তীব্র সমালোচনার মুখে হোয়াইট হাউস

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিপাকে পড়েছে হোয়াইট হাউস। আগামী সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করার কথা তার। এছাড়া তিনি মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণও দেবেন। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো মোদিকে এভাবে আমন্ত্রণ জানানোর তীব্র সমালোচনা করেছে। হাফপোস্টের খবরে বলা হয়, ভারত সরকার এই সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। অপরদিকে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, মোদির এই সফর ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে নিরাপদ ও মুক্ত করতে ভূমিকা রাখবে। 

কিন্তু সমালোচকরা মোদির এই সফরের বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছেন। তারা দাবি তুলেছেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদের তীব্র উত্থানের কারণে ভারতে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে তার বিষয়ে মোদিকে চাপ দিতে হবে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়কে মুছে দিয়ে দেশটিকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে চায়। তাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অব্যাহতভাবে রাষ্ট্র-অনুমোদিত সহিংসতা এবং হয়রানির ঝুঁকিতে রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, এমন অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই এই হিন্দুত্ববাদের উত্থানের পেছনে মোদির ভূমিকা উপেক্ষা করতে পারে না।

‘মিডনাইটস বর্ডারস: এ পিপলস হিস্ট্রি অফ মডার্ন ইন্ডিয়া’ এর লেখক সুচিত্রা বিজয়ন বলেন, গত প্রায় এক দশক ধরে মানবাধিকার কর্মীরা নিয়মিত হোয়াইট হাউসকে জানিয়ে আসছেন যে, মোদির সরকার কর্তৃত্ববাদী, কট্টর ডানপন্থি, মুসলিম বিরোধী এবং সব সংখ্যালঘুদের বিরোধী। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয় সরকারের কাছেই এ নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীরা যেভাবে হোয়াইটওয়াশ করে চলেছে তা খুবই উদ্বেগজনক।

মোদিকে ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে হিন্দু চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন দিয়েছিলেন। অথচ এই গোষ্ঠীগুলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মুসলমানদের টার্গেট করার জন্য অভিযুক্ত। তবে এখন নিজের তৃতীয় হোয়াইট হাউস সফরের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন মোদি। এবার তিনি কংগ্রেসের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। এর আগে ২০১৬ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়েও ওই সম্মান পেয়েছিলেন।

তবে এবার ভারতে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে একযোগে সরব হয়েছে একাধিক মানবাধিকার সংগঠন। মোদির আমেরিকা সফর চলাকালীন আগামী সপ্তাহে সেই নিয়ে ওয়াশিংটনে বিক্ষোভ দেখাতে চলেছে তারা। আগামী ২২শে জুন মোদিকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানাবেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মূলত চীন ইস্যুতেই আলোচনা হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। সীমান্ত ইস্যুতে ভারত এবং চীনের মধ্যে বহু আগে থেকেই উত্তেজনা চলছে। আবার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার পর চীনই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।

ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাই শত্রুর শত্রু বন্ধু, এই নীতি নিয়েই ভারত এবং আমেরিকা দেশ চলতে চাইছে বলে মত কূটনীতিকদের। যে কারণে ২২ জুন হোয়াইট হাউসের বাইরে মানবাধিকার সংগঠনগুলি একজোট হয়ে বিক্ষোভ দেখালেও, তাতে পারস্পরিক আলোচনা এবং সম্পর্ক প্রভাবিত হবে না বলেই ইঙ্গিত মিলছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, মোদি হোয়াইট হাউসে যাবেন যখন, সেই সময় বাইরে বিক্ষোভ দেখাবে দ্য আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল, পিস অ্যাকশন, ভেটরান্স ফর পিস এবং বেথেসডা আফ্রিকান সিমেট্রি কোয়ালিশন প্ল্যানের মতো সংগঠন। হোয়াইট হাউসের বাইরে মোদিকে লক্ষ্য করে ‘মোদি নট ওয়েলকাম’, ‘সেভ ইন্ডিয়া ফ্রম হিন্দু সুপারমেসি’র মতো ধ্বনি তোলা হতে পারে বলে জানা গেছে।

এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের বিরোধিতায় ‘হাউডি ডেমোক্রেসি’ নামের একটি নাটকেরও আয়োজন করা হয়েছে নিউ ইয়র্কে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন মোদি। তাকে স্বাগত জানাতে আয়োজন করা হয়েছিল ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠান। যা কার্যতই ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চে পরিণত হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের আদলেই ভারতের গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে ‘হাউডি ডেমোক্রেসি' নাটক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে।

এর পাশাপাশি ওয়াশিংটনে আগামী সপ্তাহে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তরফে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দেশের নীতি নির্ধারণকারী থেকে সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে গুজরাট দাঙ্গায় মোদির ভূমিকা নিয়ে তৈরি বিতর্কিত তথ্যচিত্রের প্রদর্শন করা হবে।

মোদির সফর নিয়ে ইতোমধ্যেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সংগঠনের এশিয়া বিভাগের ডিরেক্টর এলেন পিয়ার্সন বাইডেনকে চিঠি দিয়েছেন। মোদির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তো বটেই, প্রকাশ্যেই ভারতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। তবে মোদিকে বেশ ভাল রকমের সম্মানই দেখাতে যাচ্ছেন বাইডেন। তার জন্য আয়োজন করা হচ্ছে স্টেট ডিনারের। এর আগে শুধুমাত্র দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ও ফ্রান্সের ফার্স্ট লেডির সম্মানে এ আয়োজন করেছিলেন বাইডেন।

ভারতে মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্বেগের বিষয়ে চাপ দেয়া হলে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জিন-পিয়ের মোদির এই সফরের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি বলেন যে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন বিশ্বাস করেন- ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ নিয়ে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে হাফ পোস্ট। কিন্তু সেখান থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।

বাইডেন চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব কমাতে মূলত মার্কিন-ভারত সম্পর্ক জোরদার করতে চাইছেন। এ জন্য তিনি ভারতের কাছে কয়েক বিলিয়ন ডলারের সশস্ত্র মার্কিন ড্রোন বিক্রি করতে যাচ্ছেন। মোদির এই সফরেই ড্রোন কেনার বিষয়ে চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। বিজয়ন বলেন, হোয়াইট হাউসে কে আছেন এটা আসলে খুব একটা পার্থক্য সৃষ্টি করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য প্রায়ই কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সমর্থন দেয়।

২০২০ সালের হিসাবে ভারতের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান। এছাড়া খ্রিস্টানরা দেশের জনসংখ্যার ২ থেকে ৩ শতাংশ। গত মাস থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বের একটি প্রত্যন্ত রাজ্য মণিপুরে জাতিগত সহিংসতা চলছে। যেখানে গির্জা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া হত্যা করা হয়েছে কয়েক ডজন লোককে, যাদের বেশিরভাগই খ্রিষ্টান। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান আমেরিকান খ্রিষ্টান অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান জন প্রভুদোস হাফপোস্টকে বলেছেন যে, তিনি কয়েক ডজন ভারতীয় পাদ্রির সাথে যোগাযোগ করছেন। তাদের বেশিরভাগই ভারতে থাকা তাদের পরিবারের জন্য আতঙ্কিত। তাদের পরিবার কারাগারে যেতে পারে, এমনকি খুনও হতে পারে। এই ভয়টা একেবারেই বাস্তব।

প্রভুদোস গুজরাট দাঙ্গার পরে ২০০২ সালে আইন প্রণেতাদের সাথে ভারতে গিয়েছিলেন এবং সহিংসতার প্রভাব সরাসরি দেখেছিলেন। তিনি বলেন, মোদির এই সফর ‘ক্ষমার অযোগ্য’। একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য মোদির মতো মানুষকে হোয়াইট হাউসে নিয়ে আসাটা লজ্জাজনক। তিনি বাইডেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘শেম অন ইউ’।