বড় বাজেটের বোঝা চাপবে ভোক্তার কাঁধে
আগামী ১লা জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে জাতীয় বাজেট উত্থাপন করবেন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন : আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার হবে প্রায় ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার উপরে। আগামী ১লা জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদে জাতীয় বাজেট উত্থাপন করবেন। ইতিমধ্যে বাজেটের রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে আগামী বাজেটে সাধারণ জনগণের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপানো হচ্ছে না। তবে এই বিশাল আকারের বাজেটে থাকবে কর আদায়ে বাড়তি চাপ। সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকার মধ্যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ লাখ কোটি টাকা। বিশাল আকারের এই বাজেটের অর্থ আদায়ের পরিধি বাড়াতে করজাল বিস্তারে গ্রামাঞ্চলে প্রাইভেট এজেন্ট নিয়োগ করা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আসন্ন বাজেটে সাধারণ জনগণের ওপর বাড়তি করের বোঝা বাড়বে। কারণ ইতিমধ্যে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। বৈদেশিক সাহায্যের গতিও কম। ফলে বাজেটে যে ঘাটতি থাকে সেটা আরও বাড়বে। তবে আইএমএফ’র টাকা কিছুটা স্বস্তি দেবে। দেশে জ্বালানি সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। রিজার্ভ কমে যাওয়া ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে ঋণপত্র খোলা ও পণ্য আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে মূল্যস্ফীতিও বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই এসব সমস্যা বিবেচনায় নিয়েই আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও অর্থনীতিবিদেরা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৮৭ লাখ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএনধারী) আছেন। তাদের মধ্যে ২৯ লাখের মতো টিআইএনধারী প্রতিবছর নিজেদের আয়-ব্যয়ের তথ্য জানিয়ে রিটার্ন দেন। সূত্র জানায়, দেশে মাত্র ১৮ থেকে ২০ লাখ মানুষ আয়কর দেন। দেশের কর জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। দেশে প্রদেয় করদাতার অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক। এদিকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। শর্তস্বরূপ রাজস্ব খাতে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে, বাড়াতে হবে কর জিডিপি। আইএমএফ’র আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ০.৫ শতাংশ বাড়তি কর আদায় করতে হবে। এজন্য আগামী বাজেটে বাড়তি কর আদায়ের নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া শর্ত পূরণ করতে আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে রাজস্ব হিসাবে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে বিদ্যমান সারচার্জ ৫ থেকে ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। ফলে ধনীদের দিতে হতে পারে আরও উচ্চ কর।
ইতিমধ্যে এনবিআর বাড়তি কর আদায়ে একগুচ্ছ উদ্যোগ নিয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত ৫০ বছরে ২ শতাধিক প্রজ্ঞাপন জারি করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর ছাড় দেয়া হয়েছে। এখন এগুলো পর্যালোচনা করছে এনবিআর। যেসব কর ছাড়ের আর প্রয়োজন নেই, সেগুলো বাদ দেয়া হবে। একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলে বাড়তি আয়কর আরোপের প্রস্তাব থাকতে পারে।
বাজেটে উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সারচার্জ ৫ থেকে ১০ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। ফলে ধনীদের দিতে হতে পারে আরও উচ্চ কর। সারচার্জ হচ্ছে একধরনের ‘অতিরিক্ত’ কর। ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের ক্ষেত্রে কারো নির্দিষ্ট সীমার বেশি সম্পদ থাকলে নিয়মিত কর দেয়ার সঙ্গে ‘বাড়তি’ এই সারচার্জও পরিশোধ করতে হয়। নিট সম্পদের ওপর ভিত্তি করে এটি ধার্য করা হয়।
কর আদায় বাড়াতে সিগারেটের মূল্যস্তর ও শুল্ক দু’টি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হতে পারে আগামী বাজেটে। বাড়তে পারে ভ্রমণ কর। সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায় বাড়াতে আমদানি করা গাড়ি, ফ্রিজ ও এসি’র মতো পণ্যের সম্পূরক শুল্ক ও করের হার বাড়ানো হতে পারে। জানা গেছে, আগামী অর্থবছর গ্রামাঞ্চল থেকে কর সংগ্রহ করতে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বেসরকারি কর সংগ্রহ এজেন্ট নিয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে। রাজস্ব বোর্ড সূত্র মতে, নতুন কর এজেন্টরা নতুন করদাতাদেরও সাহায্য করবে। ই-টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যারা এখনো কর রিটার্ন জমা দেননি, তাদের রিটার্ন প্রস্তুত করতেও সহায়তা করবে। সমপ্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকে এনবিআর কর্মকর্তারা এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, আমাদের জিডিপি বাড়ছে, কিন্তু কর আদায় হচ্ছে না। পরীক্ষামূলকভাবে কর এজেন্ট নিয়োগ করা উচিত। এ উদ্যোগ করদাতাদের সচেতন করবে।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, আগামী অর্থবছর থেকে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বাড়তে পারে। বর্তমানে বার্ষিক আয়ের প্রথম ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো কর দিতে হয় না। এটি বাড়িয়ে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত করা হতে পারে। আগামী ১লা জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত বাজেটে এ ঘোষণা দিতে পারেন অর্থমন্ত্রী। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে সাধারণ করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই চিন্তাভাবনা করছে। এদিকে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। জীবনযাত্রার ব্যয়, মূল্যস্ফীতি এবং সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকায় উন্নীত করার দাবি করা হয়েছে।
সূত্রমতে, আগামী অর্থবছরে করপোরেট কর কমানো বা বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব রাখছে না এনবিআর। করপোরেট কর অপরিবর্তিত থাকছে। টানা গত দুই বছর করপোরেট কর কমানো হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে নতুন বাজেট করা হচ্ছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বাজেটে দেখতে চাই। দেশে মূল্যস্ফীতি এখন অন্যতম সমস্যা, রপ্তানি ও আমদানি কমছে, ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ কমছে, এমন পরিস্থিতিতে সরকার এসব বিষয়ে কী ভাবছে, তার একটা ব্যাখ্যা বাজেটে দেখতে চাই।
তিনি বলেন, বাজেটে যে পরিমাণে ব্যয় ধরা হয়, তার চেয়ে রাজস্ব আদায় অনেক কম। এটা কীভাবে সমাধান করা হবে, তারও দিকনির্দেশনা বাজেটে থাকা প্রয়োজন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়। মূল্যস্ফীতি বাগে আনা এবারের বাজেটের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। মূল্যবৃদ্ধির জন্য শুধু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দোহাই দিলে হবে না।
উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে ৩১শে মে। এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বাজেট অধিবেশন আহ্বান করেছেন। আগামী ১লা জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের জাতীয় বাজেট পেশ করার কথা রয়েছে। ঈদুল আজহার ছুটির আগেই সরকার আগামী জাতীয় বাজেট শেষ করতে চায় বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
ডলার সংকট ও আমদানি কড়াকড়িতে শুল্ক আদায়ে ধস নেমেছে। একই অবস্থা আয়কর আদায়েও। সূত্র জানায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে আমদানি-রপ্তানি, ভ্যাট ও আয়কর খাত মিলে এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৩২ কোটি টাকা বা ৮.২৮ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
পিআরআইয়ের হিসাব অনুসারে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৫৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা হতে পারে।