বেরিয়ে এলো পলকের ‘ফাইভ স্টার বাহিনীর’ থলের বিড়াল

পলকের সহযোগী হিসাবে গত পনেরো বছরে বিপুল টাকা-পয়সা কামিয়ে এরা রাজকীয় জীবনযাপন করেছেন।

বেরিয়ে এলো পলকের ‘ফাইভ স্টার বাহিনীর’ থলের বিড়াল

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কারাবন্দি সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ২০০৮ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হয়েই এলাকায় গড়ে তোলেন ‘ফাইভ স্টার বাহিনী’। পাঁচজনের এই বাহিনীর সদস্য ছিলেন-আরিফুল ইসলাম, জান্নাতুল ফেরদৌস, ডালিম আহমেদ ডন, শরিফুল ইসলাম শরীফ ও সোহেল তালুকদার। পলকের সহযোগী হিসাবে গত পনেরো বছরে বিপুল টাকা-পয়সা কামিয়ে এরা রাজকীয় জীবনযাপন করেছেন।

এই বাহিনীর সবচেয়ে চতুর ও ধূর্ত সদস্য উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম আরিফ। তিনি ছিলেন পলকের প্রধান পরামর্শদাতা। তার গ্রামের বাড়ি সাতপুকুরিয়া হলেও পলক প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সিংড়া পৌর শহরের চাঁদপুর মহল্লায় একটি চারতলা বাড়ি করে তিনি বসবাস করেন। বাড়িটির বাইরে থেকে তেমন কিছু বোঝা না গেলেও এটি সিংড়া উপজেলার অন্যতম ‘রাজকীয় প্রাসাদ’ বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বাড়ির ভেতরের প্রতিটি কারুকাজ দেখে মনে হয় যেন স্বর্ণখচিত। নিজের বাড়ির পাশেই গড়ে তুলেছেন তার আপন ছোট ভাই উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান ওরফে লিখনের আরেকটি রাজপ্রাসাদ। 

অভিযোগ রয়েছে, সহোদর এই দুই ভাইয়ের দ্বারা এই এলাকার সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বর্তমানে এই এলাকায় প্রায় দেড়শ বিঘা জমির মালিকানাসহ শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন আরিফুল ইসলাম আরিফ। অথচ কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একটি প্রাইভেট কোম্পানির মার্কেটিংয়ে চাকরির মাধ্যমে। তার বাবা আলাউদ্দিন পেশায় একজন আইনজীবী হলেও তাদের পরিবারে তেমন সচ্ছলতা ছিল না। পৈতৃক সূত্রে ৫ থেকে ৭ বিঘা কৃষিজমির মালিক ছিলেন। সিংড়া পৌর শহরের চাঁদপুর মহল্লার একটি টিনশেড ভাড়া বাড়িতে অতিকষ্টে ছিল তাদের জীবনযাপন।

পলকের কথিত ফাইভ স্টার বাহিনীতে যোগদানের পর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের আমলেও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন আরিফ। পরে ইটালী ইউনিয়ন পরিষদের উপনির্বাচনে চেয়ারম্যান হন তিনি। এরপর আরও দুবার ভয়ভীতি ও পেশিশক্তি খাটিয়ে অন্যদের বসিয়ে দিয়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এলাকায় সরকারি জলাশয় ও পুকুর দখল, টেন্ডারবাজি, কৃষি জমির মাটি বাণিজ্য, বিচার-সালিশ, স্কুল-কলেজে নিয়োগ এবং বদলি বাণিজ্য করে কমপক্ষে একশ কোটি টাকা কামিয়েছেন। আপন মামা আহসান হাবিব ও মামাতো ভাই যুবলীগ নেতা আবুল বাসার ওরফে আশিক এবং আপন খালু কাজল খাঁর মাধ্যমে এলাকায় সরকারি ঘর ও খাল-বিল বিক্রি, সালিশ-বিচারের নামে অর্থ আদায় ও বিরোধী মতের মানুষের ওপর দমন-নির্যাতন চালিয়েছেন। এলাকার অসংখ্য মানুষ এই অভিযোগ করেছেন।

ফাইভ স্টার বাহিনীর আরেক সদস্য সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়র মো. জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনিও শতকোটি টাকার মালিক। জান্নাতুল ফেরদৌস এক সময় পলকের বাড়ির নিচে খৈল-ভুসির দোকান ও সিগারেট বিক্রেতা ছিলেন বলে জানা যায়। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই বললেই চলে। আ.লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফাইভ স্টার বাহিনীর নামে উপজেলাজুড়ে চাঁদাবাজি শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন বিএনপির পৌর মেয়র ও ম্যাব মহাসচিব শামিম আল রাজিকে অস্ত্র ঠেকিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন। তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে সিংড়া ছাড়তে বাধ্য করেন। ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সিংড়া পৌরসভা নির্বাচনে ভয়ভীতি, হুমকি ও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দিয়ে পৌর মেয়র নির্বাচিত হন ফেরদৌস। এরপর শুরু করেন সিংড়া পৌর বাস টার্মিনালে দোকান বাণিজ্য, মহাসড়কে চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ডিও ব্যবসা, সরকারি পুকুর দখল, গরুর হাট ভরাটের নামে অর্থ আত্মসাৎ এবং পৌরসভায় সোলার লাইট স্থাপন, রাস্তাঘাট সংস্কারসহ উন্নয়ন প্রকল্প দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। তিনি শেরকোল এলাকায় গড়ে তোলেন বিটিএ ইটভাটা, গরুর খামার, তৎসংলগ্ন ১২ বিঘা জমিও কিনেছেন। নাটোর-বগুড়া মহাসড়কে বালুভরা-নিংগইন এলাকায় প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর তার রয়েছে মাটি-বালুর ব্যবসা। সিংড়ার আউকুড়ি মৌজায় তার দোতলা বিল্ডিং ও গোডাউন, সিংড়া বাজারে তিনতলা বিল্ডিং, নাটোর-বগুড়া মহাসড়কসংলগ্ন বিচিত্রা সিনেমা হলের কোটি টাকার সম্পদ, পৌর শহরের গার্লস স্কুল ও থানা মোড় এলাকায় শৈলাশ নন্দীর কাছ থেকে নেওয়া প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ, উপজেলা কৃষি কার্যালয়সংলগ্ন কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ, ডাহিয়া ইউনিয়নের কৈডালা, বিলপাকুরিয়া ও মিমলসি মৌজায় প্রায় শত বিঘা কৃষিজমি। ঢাকায় ফ্ল্যাট বাড়ি-গাড়ি।

এছাড়া রূপালী ব্যাংক নাটোর শাখায় তার স্ত্রী আসমাউল হুসনা নিপার নামে প্রতি মাসে লাখ টাকা জমার ডিপিএস রয়েছে বলে তার আত্মীয়-স্বজন সূত্রে জানা গেছে। সিংড়া পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনের আবাসন প্রকল্প ব্যবসায় মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস পার্টনার হিসাবে রয়েছেন বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এই বাহিনীর আরেক সদস্য সিংড়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ডালিম আহমেদ ডন। শিক্ষাগত যোগতা বলতে কিছুই নেই। তার বাবা পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল মান্নান মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন। সিংড়া ফেরিঘাট এলাকায় অবস্থিত রানীমহলে সকাল-সন্ধ্যা বসে মাদকের হাট। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফেরিঘাটসংলগ্ন গরু-মহিষ হাট এলাকাজুড়ে ছিল ডনের রাজত্ব। মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড তারই নেতৃত্বে চলত। গরু হাটের জায়গা দখল করে গোডাউন ও দোকান বাণিজ্য করেছেন। প্রশাসনের নাকের ডগায় আইকুড়ি মৌজায় সরকারি প্রায় ৪০ বিঘা কৃষিজমি খনন করে মাটি বাণিজ্য এবং এখনো সেই জমিতে মাছের ঘের করে দখলে রেখেছেন। সিংড়া বাস টার্মিনাল এলাকায় তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পুরো সময়ে শ্রমিক সংগঠনের নামে যানবাহনে ব্যাপক চাঁদাবাজি চলত। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও সিংড়া পৌর আ.লীগের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন ডন। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বরাদ্দের নামে চাঁদাবাজি, জায়গা দখলসহ তার ডনগিরির কাছে আওয়ামী লীগের আমলে উপজেলার সবাই জিম্মি ও বোবা হয়ে গিয়েছিল। সিংড়া গরু হাট এলাকার বিধবা নারী কাজীনুর জরিন জাহানের কাছ থেকে কোটি টাকার সম্পদ জবরদখল করে গোডাউন নির্মাণ, শিক্ষিকা জেসমিন সরকারের ৩০ লাখ টাকার জায়গা দখল, কৃষক শামসুল ইসলামের জায়গা দখল, ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নানের জায়গা দখলসহ বিভিন্ন মানুষের জায়গা দখলের অভিযোগ রয়েছে।

উপজেলা যুবলীগের সভাপতি সোহেল তালুকদার এই বাহিনীর আরেক সদস্য। এক সময়ের মুদি দোকানি আর রেন্ট-এ-কারের গাড়ির চালক থেকে এখন তিনিও কোটিপতি। পুরো আওয়ামী লীগ আমলে সিংড়া মৎস্য আড়ত ও সিংড়া বাস টার্মিনাল এলাকাকেন্দ্রিক চলে তার দখলদারিত্ব। পুকুর দখল, টেন্ডারবাজিসহ নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সিংড়া বাস টার্মিনালের বাস, ট্রাক, সিএনজিসহ বিভিন্ন যানবাহনের চাঁদার ভাগ নিয়মিত যেত তার পকেটে। ২০১৭ সালে নিজের ছেলে ইশানের নামে একটি মৎস্য আড়ত বসিয়ে সিংড়া মৎস্য আড়ত নিয়ন্ত্রণে নেন সোহেল তালুকদার। চলনবিলের অবৈধ সোঁতি, বানা, বাদাই ও সরকারি খাল-বিল, জলাশয়ের কয়েক কোটি টাকার মাছ তার আড়তে কেনাবেচা করতে সাধারণ মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীদের বাধ্য করেন। আত্মসাৎ করেন মৎস্য আড়তদার সমিতির সদস্যদের গচ্ছিত অর্থ।

এই বাহিনীর আরেক সদস্য ছিলেন উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি শরিফুল ইসলাম। তবে তিনি অন্য চারজনের মতো অত বেশি সম্পদ গড়ে তুলতে পারেননি। ফাইভ স্টার বাহিনী গড়ে তোলার কয়েক বছর পরই তার সঙ্গে পলকের মতপার্থক্য হওয়ায় তাকে পদ-পদবি থেকে বঞ্চিত করে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। জুনাইদ আহমেদ পলক বিমানবন্দর থেকে আটক হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়াতেই গা-ঢাকা দেন ফাইভ স্টার বাহিনীর আলোচিত এই পাঁচ সদস্য।