পদ্মাসেতু : যার যা প্রাপ্য

পদ্মাসেতু : যার যা প্রাপ্য

প্রথম নিউজ, ডেস্ক : ডাবল ডেকার বা দোতলা পদ্মাসেতুর একতলার কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এর ওপর দিয়ে এখন থেকে মোটরযান চলাচল করবে। অর্থাৎ এই সেতুর ওপর দিয়ে মোটরযানে চড়ে প্রমত্তা পদ্মানদী পাড়ি দেয়া যাবে। এরপর এই সেতুতে বসবে সিঙ্গল ট্র্যাক রেলপথ। এ জন্য লাগবে আলাদা বাজেট, ভিন্ন অর্থায়ন, পৃথক প্রকল্প ও আরেক আয়োজন। রেলপথ তৈরি হয়ে গেলে রেলে চড়েও পাড়ি দেয়া যাবে পদ্মা।দৈর্ঘ্যে বিশ্বের ১২২ তম এই সেতু। আর অর্থ ও সময় ব্যয় এবং কাঠামোগত দিক দিয়ে এটি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচে' বড় পুরকৌশল স্থাপনা। রিভার এঞ্জিনিয়ারিংয়ে এই স্থাপনায় বিদেশীদের সংগে আমাদের স্বদেশী মেধাও জড়িত ছিল। এটা পদ্মানদীর ওপর তৃতীয় সেতু। শতবর্ষ আগে ইংরেজ শাসকেরা পদ্মার ওপর প্রথম রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বানায়। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর বিগত সরকার আমলে পদ্মার ওপর লালন শাহ্ সেতু নির্মাণ করান। তবে বর্তমান পদ্মাসেতু আগের দু'টির তুলনায় অনেক বেশি দৈর্ঘ্য ও প্রশস্ততাসম্পন্ন। আপাততঃ শুধু মোটরযান পারাপার হলেও এ সেতুতে রেলপথও যুক্ত হবে আগামীতে।

প্রত্যাশিত হারে না হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জাতীয় বাজেট ক্রমেই বড়ো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে লুটপাট ও দুর্নীতির মাত্রাও বেড়ে চলেছে। জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্রহীন বর্তমান শাসনামলে তা' ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এই বাস্তবতার মধ্যেই আমাদের রাষ্ট্র ক্রমে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়ার সাহস ও সামর্থ অর্জন করেছে। ১৯৯১ সালে নির্বাচিত খালেদা জিয়ার সরকার যমুনা নদীর ওপর সেতু তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকার পরে আরো বড় প্রকল্প পদ্মাসেতু হাতে নেয়। পদ্মাসেতু নিয়ে নানা রঙের বিতর্ক থাকলেও এটি যে আমাদের জাতীয় গৌরবের ক্ষেত্রে এ যাবতকালের সবচে' বড়ো কাঠামো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি নির্মাণের আগে আমাদের জাতীয় গৌরবের তিনটি বৃহত্তম স্থাপনা ছিল: জাতীয় সংসদ ভবন, জিয়া (বর্তমানে হযরত শাহজালাল) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং যমুনা (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু) সেতু।সরকার যেমন ধারাবাহিকতা, রাষ্ট্রীয় প্রকল্পগুলোও তাই। যমুনা সেতুর প্রায় ৮৫ শতাংশ কাজ বিএনপি সরকার সম্পন্ন করে যায়। পরে কেয়ারটেকার সরকার সে কাজ অব্যাহত রাখে। এর পরের ইলেকশনে আওয়ামীলীগ সরকার গড়লে শেখ হাসিনা সে সেতুর নাম বদল করে তা' উদ্বোধন করেন। অথচ খালেদা জিয়া যে-দিন যমুনা সেতুর ভিত্তিস্থাপন করেন সে-দিন শেখ হাসিনা সারাদেশে হরতাল ডেকেছিলেন।
যমুনা সেতু নির্মাণে খালেদা জিয়ার ভূমিকা ও কৃতিত্বের কথা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঘূর্ণাক্ষরেও বলা হয়নি। এমনকি সামান্য সৌজন্য দেখিয়ে তাঁকে নিমন্ত্রণও করা হয়নি। যদিও তিনি ১১৬ আসন নিয়ে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহত্তম বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন। শুধু কি তাই? যমুনা সেতুর নির্মাতা খালেদা জিয়ার গাড়িবহরকে কয়েকবার সেতু অতিক্রমে বাধা দিয়েছে তৎকালীন আওয়ামী সরকার। এই সব ছোটলোকি ও ক্ষুদ্রতা আমাদের রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। দেশের মানুষের কিংবা বিদেশী ঋণের টাকায় আমরা যতো বড়ো বড়ো প্রকল্পই হাতে নিই-না কেন, মনটা কিন্তু আমাদের ছোট ও নীচুই রয়ে গেছে। পদ্মাসেতুর কাজেও ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সরকার ভূমিকা রেখেছে। শেখ হাসিনার সরকার ছাড়াও খালেদা জিয়ার সরকার ও ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনদের জরুরি সরকারের আমলেও এ সেতুর কাজ এগিয়েছে। এ সত্য অস্বীকার করাটা হবে জঘণ্য মিথ্যাচার। কাজেই পদ্মাসেতু প্রকল্পের সূচনা থেকে এদেশের কোনো দল বা সরকারই পদ্মাসেতুর বিরোধী ছিল না। কাউকে কাউকে পদ্মাসেতু-বিরোধী বা সেতুদ্রোহী বলে প্রচার করাটা খুবই নোংরা কূটচাল। এসব মিথ্যাচার করার জন্য অনেক দুর্বুদ্ধিতাড়িত দুষ্ট লোক এদেশে যে রয়েছে, তা-তো দেখাই যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সেতুবিরোধী না হলেও আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সেতুবিরোধী মানুষ। পদ্মা-যমুনা সব সেতুরই আমি বিরোধী। আমাদের নদীগুলো প্রবল ভাঙ্গনপ্রবণ। উজান থেকে স্রোতে বয়ে আনা বিপুল পরিমাণ বালি ও পলি থিতিয়ে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। নদীগুলোর পানিপ্রবাহ উজানে অন্য দেশের নিয়ন্ত্রণে। এসব বাস্তবতার কারণে এদেশে বড়ো বড়ো সেতু ও বাঁধ নির্মাণকে আমি অপচয় ও ক্ষতিকারক কাজ মনে করি। নদীগুলোর প্রবাহ যাতে এইসব সেতু থেকে সরে না যায় তার জন্য ফি-সন কোটি কোটি টাকা ঢালতে হয়। আমি মনে করি, এসব উন্নয়ন-ভাবনা ত্রুটিপূর্ণ এবং আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিহীন। এর বদলে বেশি প্রয়োজন নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীগুলোর নাব্যতা ও প্রবাহ ঠিক রাখা। নদীভাঙ্গন রোধ করা। নৌপথ, নৌচলাচল, নৌবন্দর ও ঘাটগুলো ঠিক রাখা। সুষ্ঠু নৌপরিবহন নিশ্চিত করা। নৌদুর্ঘটনা রোধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়া। তবে, জাতীয় জীবনে আমার ব্যক্তিগত এসব মতামত যে গুরুত্বহীন, তা' আমি জানি।
পদ্মাসেতু তৈরির জন্য খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে যে ব্যয়বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় তা' শেখ হাসিনার আমলে দফায় দফায় বাড়ানো শুরু হয়। সরকার-বিরোধিরা স্বাভাবিকভাবেই এ ব্যয়বৃদ্ধির বিরোধিতা করে। এরপর সেতু নির্মাণে ঋণ দেয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সে-সব অভিযোগ তদন্ত ও নিষ্পত্তির আহ্বান জানায়। তাদের অভিযোগের ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ পছন্দসই না হওয়ায় এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায়। চুক্তিবদ্ধ অন্যান্য বিদেশী সংস্থাও বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে। পদ্মাসেতুতে স্বল্পসুদের দীর্ঘমেয়াদী বিদেশী ঋণের চুক্তিতে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোকে ধরে রাখতে না পারা সরকারের একটা ব্যর্থতা। তারা পদ্মাসেতু থেকে সরে গেলেও অন্যান্য প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে। কাজেই তারা বাংলাদেশ সরকারের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। তাদেরকে 'ষড়যন্ত্রকারী' সাজিয়ে প্রচারণা একটা রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি এবং প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আড়ালের চেষ্টা মাত্র। সরকার-বিরোধীরা সরকারের এসব ভূমিকার নিন্দা ও বিরোধিতা করেছে, পদ্মাসেতুর নয়।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির মতলব সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের বহুমাত্রিক অভিযোগ যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তা' উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে বিদেশী ঋণদাতাদের ধরে রাখতে পারলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত হতো ও আন্তর্জাতিক ভাবমর্যাদা বাড়তো। কিন্তু আমাদের সরকার এক্ষেত্রে হঠকারিতা করেছে। তারা কানাডার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে সে দেশের একটা আদালতের রায়কে পুঁজি করে সার্বিক অভিযোগ বা পুরো ব্যাপারটাকেই দায়মুক্ত বলে প্রচার করছে। অথচ এ প্রচারণার সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবতার দূরত্ব অনেক। পদ্মাসেতুর অর্থায়ন থেকে বিদেশীরা সরে যাওয়াতে এই সেতু নির্মাণ অনেক বিলম্বিত হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার নির্দিষ্ট মেয়াদে এটা করতে পারেনি। এতে বিরোধীদের অভিযোগই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। সেতুটি নির্মাণের কৃতিত্ব অর্জনের জন্য তাদেরকে বিনাভোটে এবং আগের রাতের ভোটে দুই টার্ম অনৈতিকভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে হয়েছে। তারপর দেশবাসীর পকেট কেটে টাকা তুলে সেতু নির্মাণ কাজ এক দশক পর সম্পন্ন করতে হয়েছে। এটাকে যদি কেবলই সাফল্য ও কৃতিত্ব হিসেবে দেখতে হয়, তা'হলে তা' দেশবাসীর। তাদের টাকায় এ ব্রিজ। প্রতিটা নাগরিক গড়ে প্রায় দু'-হাজার টাকা করে দিয়েছে এ সেতুর জন্য। তার পরেও নিজের টাকায় বানানো সেতু তাদেরকে পার হতে হবে চড়া মাশুল বা টোল দিয়ে। আর সাফল্যের সঙ্গে এসব ব্যর্থতার দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। এর ওর ওপর দোষ দিয়ে কিংবা একে ওকে নদীতে চুবাবার ইচ্ছা প্রকাশ কিংবা টুস করে ফেলে দিতে চেয়ে এইসব ব্যর্থতার কলঙ্ক মোছা যাবেনা।
পদ্মাসেতু নিয়ে উচ্ছ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে বিষোদগারের এই প্রবাহ ক্ষমতাসীন সরকারকে কতটা রাজনৈতিক ডিভিডেন্ট এনে দেবে সেটা আগামী ইলেকশন এলে বুঝা যাবে। সাফল্যের এই বয়ান দিয়ে সরকারের অপরাপর ব্যর্থতা ও অপশাসনকে আদৌ গ্রহনযোগ্য করা যাবে কিনা, তা'-ও প্রমাণিত হবে। অতি প্রচারণা জনগণ কতোটা গ্রহন করছে তা' ক্ষমতাসীনেরাও বুঝতে পারবেন হাতে-কলমেই। তা'ছাড়া এবারের প্লাবন জনিত মহাদুর্যোগকালে সেতুর জাঁকালো উদ্বোধন ও প্রচারবিলাস খুব দৃষ্টিকটু ও অমানবিক মনে হয়েছে। অনেকে মনে করেন, দেশজ সম্পদ ও দেশবাসীর অর্থায়নে গড়া পদ্মাসেতু হ'তে পারতো কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ-অভিসারী জাতীয় ঐক্যের এক মহান উপলক্ষ। কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতাসীনদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ক্রমাগত বিষ উদগীরণ সেই সম্ভাবনাকে তিরোহিত করে এই প্রকল্পকেও বিভাজন ও বিদ্বেষের স্মারকে পরিণত করেছে।
আমি বাংলাদেশকে ও এর জনগণকে আজকের দিনে অভিনন্দন জানাই। ব্যর্থতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষুদ্রতা ও অপরিক্কতার জন্য সমালোচনার পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী অনমনীয় মনোভঙ্গির জন্য আমি শেখ হাসিনাকেও কৃতিত্ব দিই। এতোটা একরোখা জেদ নিয়ে তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে না থাকলে পদ্মাসেতু হয়তো অনেক আগে অন্য কেউ উদ্বোধন করতেন। এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের সফল সমাপনী উপলক্ষে আমি এর সঙ্গে জড়িত দেশী-বিদেশী সকলকেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
 লেখক: মারুফ কামাল খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিষ্ট ; সাবেক প্রেস সচিব, বিএনপি চেয়ারপারসন  (ফেইসবুক ওয়াল থেকে)

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel:

news.google.com

https://apps.apple.com/de/app/prothomnews/id1588984606?l=en

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.prothomnews

https://youtube.com/prothom