দেশের প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি ছবি, মতবিরোধ তুঙ্গে
আন্দোলনে শামিল অনেকেই এখন হিন্দি ছবি আমদানির পক্ষে। আবার হিন্দি ছবি আমদানি দেশের চলচ্চিত্রের জন্য ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে বলেও মনে করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকে।
প্রথম নিউজ, বিনোদন ডেস্ক : বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি সিনেমা মুক্তির বিষয়ে একটা সময় শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ মানুষই বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। এমনকি হিন্দি ছবি আমদানির বিরুদ্ধে কাফনের কাপড় মাথায় জড়িয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন ঢাকাই ছবির শীর্ষ তারকা শাকিব খানসহ চলচ্চিত্রের অনেক পরিচিত মুখ। তবে সময় ও অবস্থা এখন বদলেছে। আন্দোলনে শামিল অনেকেই এখন হিন্দি ছবি আমদানির পক্ষে। আবার হিন্দি ছবি আমদানি দেশের চলচ্চিত্রের জন্য ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে বলেও মনে করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকে। এই নিয়ে দু’টি পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ এখন তুঙ্গে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে হিন্দি ছবি চালানোর ইচ্ছার কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলেন হল মালিকরা। তার সঙ্গে এবার যোগ হয়েছেন দেশের অনেক চলচ্চিত্র তারকা, পরিচালক, প্রযোজকরা। বিশেষ করে শর্ত সাপেক্ষে হিন্দি ছবি বাংলাদেশে আমদানির পক্ষে চলচ্চিত্রের ১৯ সংগঠন। গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি এসব সংগঠনের জোট সম্মিলিত চলচ্চিত্র পরিষদ এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা দেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে। জানানো হয়, শর্ত সাপেক্ষে হিন্দি ছবি বাংলাদেশে আমদানিতে কোনো আপত্তি নেই তাদের। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন মন্ত্রী। জানা গেছে, ১৯ সংগঠনের উল্লেখযোগ্য শর্তের মধ্যে রয়েছে- শুধুমাত্র বাংলাদেশের বৈধ চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিবেশকগণ বিদেশি চলচ্চিত্র আমদানির সুযোগ পাবেন, বিদেশি চলচ্চিত্র পরীক্ষামূলকভাবে শুধুমাত্র ২ বছরের জন্য আনা যাবে, আমদানি করার জন্য সরকারি অনুমতি পাওয়ার পর উপরে উল্লিখিত চলচ্চিত্র আমদানিকৃত প্রথম বছর ১০টি ও পরবর্তী বছর ৮টি চলচ্চিত্র আমদানি করতে পারবে, সকল প্রেক্ষাগৃহ প্রতি বছর ৫২ সপ্তাহের মধ্যে ২০ সপ্তাহ আমদানিকৃত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে পারবে, এসব ছবি মুক্তিকালে অবশ্যই বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র প্রদর্শন করতে হবে, দুই ঈদ ও দুর্গাপূজার সপ্তাহে বিদেশি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা যাবে না, আমদানি করার পূর্বে অথবা অনুমতি পাওয়ার পর প্রতিটি চলচ্চিত্রের জন্য আমদানিকারক সংস্থা নির্দিষ্ট পরিমাণ অনুদান (আলোচনা ও শর্ত সাপেক্ষে) সম্মিলিত চলচ্চিত্র পরিষদের তহবিলে জমা দিতে হবে। উল্লেখ্য, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রদান করা হবে।
এদিকে শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও অভিনেত্রী নিপুণ আক্তার ক’দিন আগেই বলেছিলেন, হিন্দি ছবি আনলে লাভের ১০% শিল্পী সমিতিকে দিতে হবে। যদিও সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলছেন বিষয়টি অযৌক্তিক। তবে নিজের বক্তব্যে অটল নিপুণ। এদিকে হিন্দি ছবি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির বিষয়টি তুমুল আলোচনায় আসে শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ সিনেমা আমদানির খবরে। ছবিটি আমদানি করছে পরিচালক অনন্য মামুনের পরিবেশনা সংস্থা ‘অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্ট’। দাপ্তরিক কাজে তিনি এখন রয়েছেন ভারতের মুম্বই। এদিকে ২৪শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ‘পাঠান’ মুক্তির খবর শোনা গেলেও সেটি হয়নি।
এ বিষয়ে অনন্য মামুন বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে ছবি আমদানির অনুমতির কাগজ এখনো হাতে পাইনি। সেটা পেলে সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য জমা দিতে হবে। এই প্রসেসগুলো যত দ্রুত করা যাবে, তত দ্রুত ‘পাঠান’ দেখাতে পারবো। তবে একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রমতে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চাইছে না ভাষার মাসে হিন্দি ছবি ‘পাঠান’ বাংলাদেশে মুক্তি পাক। তাই মার্চের প্রথম সপ্তাহে ছবিটি মুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে। এদিকে হলগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হিন্দি ছবি আমদানি প্রয়োজন বলে মনে করছেন হল মালিকরা। মধুমিতা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, হল বাঁচাতে হলে হিন্দি ছবি আমদানি করতে হবে, এটা কয়েক বছর ধরেই বলে আসছি। প্রতি মাসে ভালো বাংলা সিনেমা মুক্তি পায় না, যেটা ব্যবসা করতে পারে। সুতরাং হল টিকিয়ে রাখতে হলে বিকল্পও লাগবে। হিন্দি ছবি আনলে হল টিকিয়ে রাখার চেষ্টাটা করা যেতে পারে। আমি মনে করি বাংলার পাশাপাশি ভালো ও নতুন হিন্দি ছবি আসলে মানুষ সেটা দেখবে।
অন্যদিকে হিন্দি ছবি আমদানির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বরেণ্য চিত্রপরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু বলেন, ‘পাঠান’ যেদিন মুক্তি পাবে সেদিন আমার জন্য কালো দিন। কারণ বাংলা ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। উর্দু-হিন্দি ভাষার মিশ্রিত বলিউড ছবি বাংলাদেশের হলে চলতে পারে না। তাহলে আমাদের অস্তিত্ব কোথায় থাকলো। বলিউডের বেশির ভাগ ছবির ভাষাই কিন্তু উর্দু। তার সঙ্গে হিন্দির মিশ্রণ থাকে। অনেকে হল টিকিয়ে রাখার জন্য এসব ছবি চালানোর কথা বলছেন। আমার প্রশ্ন হলো- হল আগে না ভাষা আগে? হল বাঁচানো তো পরে, আগে তো ভাষাকে বাঁচাতে হবে। এ নিয়ে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খল অভিনেতা মিশা সওদাগর বলেন, যেহেতু এখনো প্রধানমন্ত্রী বলেননি, তার মানে বিষয়টি এখনো পাস হয়নি। আঠারো কোটি মানুষের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা হচ্ছে ক্রিকেট। আজ পর্যন্ত আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টে কিছু করতে পারিনি। আমি অনুরোধ করবো, যদি অনেক লোকের অনুরোধের জন্য এই দেশে নিয়ম ভেঙে নতুন কিছু করা যায় তাহলে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য আমদানি করা হোক। তিনি বলেন, আমরা বাঙালিরা দেশের ঠাকুরের চাইতে বিদেশি কুকুরকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি ওটা ওন করি না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের ভাষা দিয়ে গেছেন, একটা সংস্কৃতি দিয়ে গেছেন। উনি একটা নিয়ম কানুন করে গেছেন। কাজেই এই ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে সম্মান জানিয়ে বলবো হিন্দি ছবি মুক্তি দেয়ার আগে আরও ভাবা উচিত।
হিন্দি ছবি মুক্তির বিষয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলতি প্রজন্মের চিত্রনায়ক সাইমন সাদিক বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘পাঠান’ কিংবা যেকোনো হিন্দি সিনেমা আমদানি করা যেতে পারে, তবে তা বাংলায় ডাব করে দেখানো উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ ভারতের তামিল ভাষার ছবিও কিন্তু হিন্দি ভাষাভাষিদের জন্য হিন্দিতে ডাব করা হয়। সুতরাং, এই ডাবিংয়ের ব্যবস্থাটা করা গেলে ভালো হয়। অন্যদিকে হিন্দি ছবি নয় বাংলাদেশের ছবি দিয়েই হলগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন সিনিয়র অভিনেতা ডিপজল। তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি সিনেমা ভালো ব্যবসা করেছে। এতে করে অনেক সিনেমা হল সুফল পেয়েছে। আমি মনে করি আমরা আমাদের দেশীয় সিনেমা প্রদর্শন করলে এমনিতেই হলগুলো ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে আমার প্রযোজিত ও অভিনীত পাঁচটি সিনেমা মুক্তির তারিখ নির্ধারিত করেছি। আমরা যারা চলচ্চিত্রকে গতিশীল করতে নিয়মিত সিনেমা নির্মাণ করছি, হিন্দি সিনেমা মুক্তি দিলে আমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: