টাঙ্গাইল শাড়ির জি আই স্বত্ব নিয়ে ভারতের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে বাংলাদেশ

সম্প্রতি ওই ছাত্রের নম্বরপত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে স্কুলে শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সবাই।

টাঙ্গাইল শাড়ির জি আই স্বত্ব নিয়ে ভারতের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে বাংলাদেশ

প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: মিহি সুতোয় বুনা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শাড়ির নাম ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’। সম্প্রতি হুট করেই প্রতিবেশী দেশ ভারত দাবি করে বসে এটি তাদের ঐতিহ্য। ভারত সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে একটি পোস্টে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য বলে তুলে ধরা হয়। শুধু তাই নয়, চলতি বছরের ২ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে দু’দেশেই টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা।

দেরিতে হলেও বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ। টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি ও জি আই স্বত্ব ফিরিয়ে আনার জন্য আইনি লড়াই চালাবে ঢাকা। এজন্য আইনজীবী নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কথা হাইকোর্টকে জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে জিআই পণ্য ও জিআইযোগ্য পণ্যের তালিকা দাখিল করা হয়েছে হাইকোর্টে। প্রায় শতাধিক সম্ভাব্য জিআই পণ্যের তালিকা হাইকোর্টে জমা দিলো শিল্প মন্ত্রণালয়। 

সোমবার (৬ মে) হাইকোর্টের বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে লিখিতভাবে এসব তথ্য জানানো হয়। আদালত আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে এফিডেভিট আকারে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা।

ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা বলেন, বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই পণ্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে। সেই পণ্যটিকে ভারত তাদের পণ্য হিসেবে রেজিস্ট্রি করে প্রকাশ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি রিট করেছি। ওই রিটে রুল জারি করে আদেশ দেন হাইকোর্ট। ওই আদেশের পর সরকারের কাছ থেকে ইতিবাচক তথ্য পাওয়া গেছে। সুপ্রিম কোর্টের কাছে একটি তালিকা পেশ করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলার শতাধিক জিআই পণ্যের তালিকা করা হয়েছে। এই তালিকা ক্রমবর্ধমান হারে চলবে। আর জিআইযোগ্য পণ্যের তালিকাও দাখিল করা হয়েছে।

এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ভৌগোলিক শনাক্তকরণ (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিবন্ধনের উপযোগী পণ্যের দুটি আলাদা তালিকা প্রস্তুত করে ১৯ মার্চের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তালিকা প্রণয়নে সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। হাইকোর্টের এ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জিআই পণ্যের তালিকা তৈরি করা হয়।

আদালতে উপস্থাপন করা শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত টাস্কফোর্স কমিটির আহ্বায়ক ও মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কামরুন নাহার সিদ্দিকীর সই করা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ হাইকমিশন, নয়াদিল্লী কর্তৃক ভারতের সংশ্লিষ্ট উচ্চ আদালত/রেজিস্ট্রার বরাবর বাতিল আবেদন দাখিল করার জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পূর্বেই একটি ল’ফার্ম নিয়োগ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের জন্য জরুরি সভার আয়োজন করা হয়। সর্বশেষ সভায় ল’ ফার্ম ‘ম্যাসন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’কে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে।

হাইকোর্টে দেওয়া তালিকায় দেখা গেছে, ৬৪ জেলার মধ্যে ১৫০টি পণ্য সম্ভাব্য এবং ৩৪টি পণ্য নিবন্ধিত হয়েছে। প্রতিবেদনে শিল্প মন্ত্রণালয় আরও বলেছে উল্লিখিত পণ্যসমূহ পর্যায়ক্রমে বাড়তে পারে। ভারতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সব জিআই পণ্যের তালিকা তৈরির নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় জিআই পণ্যের তালিকা প্রস্তুত করে হাইকোর্টের দাখিল করার নির্দেশ দেন আদালত।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে নিবন্ধিত ৩৪ জিআই পণ্য হলো:

টাঙ্গাইল শাড়ি, ঢাকাই জামদানি, ঢাকাই মসলিন, পোড়াবাড়ির চমচম, মধুপুরের আনারস, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা ও লটকন, গোপালগঞ্জের রসগোল্লা, ময়মনসিংহের মন্ডা, নেত্রকোনার সাদা মাটি, জামালপুরের নকশিকাঁথা, শেরপুরের তুলশিমালা ধান, কুমিল্লার রসমালাই, চাঁদপুরের ইলিশ, সিলেটের শীতলপাটি, মৌলভীবাজারের আগর ও আগর আতর, বগুড়ার দই, রাজশাহীর মিষ্টি পান, রাজশাহী সিল্ক ও ফজলি আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত, ফজলি, ল্যাংড়া ও আশ্বিনা আম, রংপুরের শতরঞ্জি ও হাড়িভাঙ্গা আম, দিনাজপুরের কাটারিভোগ, বাগেরহাটের বাগদা চিংড়ী, যশোরের খেজুরের গুড়, চুয়াডাঙ্গার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা এবং ভোলার ইলিশ।

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় দেড় শতাধিক জিআই পণ্যের মধ্যে রয়েছে:

ঢাকার মিরপুরের কাতান, বাকরখানি, মুন্সিগঞ্জের পাতক্ষীর, আড়িয়াল বিলের খলসা, মানিকগঞ্জের খেজুরের রসের হাজারী গুড়, গাজীপুরের কাঁঠাল, কাপাশিয়ার পেয়ারা, লেবু, নরসিংদীর বাবুরহাটের তাঁতবস্ত্র, কিশোরগঞ্জের চ্যাঁপা শুটকি, অষ্টগ্রামের পনির, রাতাবোরো চাল, ফরিদপুরের খেজুর রস/খেজুরের গুড়, পাট, বাগাটের দই, গোপালগঞ্জের শিং মাছ, রিঠা মাছ, চিতল মাছ, ব্রোঞ্জের অলঙ্কার, মাদারীপুরের খেজুরের গুড়, রইনা মাছ, শরীয়তপুরের চিকন্দীর পাতক্ষীরা, কালোজিরা, রাজবাড়ীর মালাইকারি, বসন্তপুরের লুঙ্গি, গামছা, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার লালচিনি, বিরই চাল, গফরগাঁওয়ের বেগুন, নেত্রকোনার টেপি বোরো চাল, বিরই চাল, বালিশ মিষ্টি, সিলিকা বালি, সুমেশ্বরীর মহাশোল, জামালপুরের প্যারা সন্দেশ, ইসলামপুরের কাশা, ম্যান্দা (চালের গুড়া ও গরুর মাংসের তৈরী বিশেষ খাবার), শেরপুরের ছানার পায়েস, কুমিল্লার খাদি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী মিষ্টি, কুটী বাজারের ক্ষীর ভোগ, মাঠা, চট্টগ্রামের রেড চিটাগাং-গরু/লাল গরু, সাম্পান, মেজবানি কালা ভুনা, নোয়াখালীর মহিষের দুধের দই, ফেনীর সুতার তৈরি কারুকার্যময় টুপি, কক্সবাজারের টেকনাফের সুপারি, চিংড়ি শুটকি, মহেশখালীর পান, খাগড়াছড়ির হলুদ, পিনন (মহিলাদের পরিধেয় বস্ত্র), হাদি (পিননের সাথে পরিধেয় ওড়না জাতীয় বস্ত্র), বাঁশকুড়ল মার্মা পিঠা, বিনি পিঠা, সান্যা পিঠা, রাঙ্গামাটির চাকমাদের তাঁতবস্ত্র, জলডুবির আনারস, সাজেকের কমলা, হলুদ, আদা, মরিচ, বান্দরবানের আদা, জুমের বিন্নিধান, পিনন, সিলেটের মনিপুরি শাড়ি, সাতকড়া, কমলালেবু, সিলেট মৌলভীবাজারের লেবু (জারা, আধাজামির), চুঙ্গাপিঠা, চা, শ্রীমঙ্গলের আনারস, সুনামগঞ্জের বারকি নৌকা, পাথর, রাণীমাছ, হবিগঞ্জের পশুরশাইল চাউল, খাসিয়া পান, বগুড়ার শুকনো মরিচ, লাল আলু, পাবনার তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, চলনবিলের কই, সিরাজগঞ্জের গামছা, তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, তরল দুধ, মিল্ক ভিটা (দই, ঘি, মাখন, দুধ), যমুনার বাঘা আইড়, নওগাঁর নাক ফজলি আম, সুগন্ধি চাল, কালিতলার প্যারা সন্দেশ, বরই, জয়পুরহাটের লতিরাজ কচু, হাড়িভাঙ্গা মিষ্টি, নাটোরের কাঁচা গোল্লা, আম, রংপুরের বৈরালী মাছ, দিনাজপুরের বেদানা লিচু, ঢেঁকি ছাঁটা চিড়া, কুড়িগ্রামের উলিপুরের ঐতিহ্যবাহী ক্ষীরমোহন মিষ্টি, গাইবান্ধার রসমঞ্জুরী, যমুনার আইড় মাছ, নীলফামারীর বাঁশ, বাঁশের কফিন, লালমনিরহাটের ভুট্টা, তামাক, ঠাকুরগাঁওয়ের সূর্যপুরী আম, খুলনার হরিনা চিংড়ী, সুন্দরবনের মধু, চুই ঝাল, গলদা চিংড়ি, ভেটকি মাছ, বাগেরহাটের সুন্দরবনের মধু, গোলপাতা, সাতক্ষীরার মাটির টালী, কেওড়ার আচার, ভাঙ্গান মাছ, পারশে মাছ, নারকেল কুল, যশোরের জামতলার রসগোল্লা, নকশিকাঁথা, নড়াইলের প্যারা সন্দেশ, মাগুরার ছানা মিষ্টি, হাজরাপুরী লিচু, মেহেরপুরের সাবিত্রী মিষ্টি, সাবিত্রী রসকদম, হিমসাগর আম, ঝিনাইদহের সন্দেশ, মহেশপুরের ঘটি দই, কালিগঞ্জের ল্যাংচা, হরি ধান, কুষ্টিয়ার কুমারখালির চাদর, বরিশালের আমড়া, গৌরনদীর দই, গুটিয়ার সন্দেশ, ঝালকাঠির গামছা, নলছিটির মুড়ি, ভোলার মহিষের দুধের কাঁচা দই, গুড়ের মিষ্টি, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির পেয়ারা, বরগুনার রাখাইন তাঁতবস্ত্র, সুপারি, তরমুজ ও পটুয়াখালীর মৃৎশিল্প।

টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি আসলে কোথায়?

ইতিহাসবিদ, গবেষক ও এই শিল্পের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে জানা যাচ্ছে, এই শাড়ির উৎপত্তিস্থল সুনির্দিষ্টভাবে পাথরাইল, নলশোধা, ঘারিন্দাসহ টাঙ্গাইলের ২২ থেকে ২৩টি গ্রামে। এসব গ্রাম বাইশগ্রাম নামেও পরিচিত এবং এটি ছিল টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির তাঁতিদের অঞ্চল। এসব তাঁতির পদবি ছিল ‘বসাক’।

তাঁতিদের বংশধরদের একজন হরিপদ বসাক। ‘পূর্ব বাংলায়’ তার জন্ম ও বেড়ে উঠা হলেও বর্তমানে বসবাস করেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ায়। তিনি এক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন, উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটিশ ভারতে টাঙ্গাইল ছিল ময়মনসিংহ জেলার মহকুমা। ১৮৫০ বা তার কাছাকাছি সময়ে তৎকালীন ধামরাই এবং চৌহট্ট নামে দুটি গ্রামে মসলিনের উত্তরসূরি কিছু তাঁতি বসবাস করতেন। সন্তোষ, করটিয়া, দেলদুয়ারে জমিদারী প্রথা পত্তনের সময় তাদের স্থানান্তরিত করে বসতি স্থাপন করা হয়। এসব গ্রামের মানুষ যে শাড়ি বুনতেন সেটাই ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’। তবে হরিপদ বসাক মনে করেন, এটা নিয়ে আলোচনার অবকাশ থেকে যায়।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম বলেন, এটা যে এখানকার অর্জন, সেটার ৫০ বছরের সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতা দিতে হয়। অথচ টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি আড়াইশ’ বছরের পুরোনো। টাঙ্গাইল শাড়ি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রাখে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও জানিয়েছেনস, ভারত যে ঘটনাটা ঘটিয়েছে, তারা ডকুমেন্টেশনে উল্লেখ করেছে- পাথরাইলের বসাক পরিবারের আদি পুরুষরা সেখানে গিয়ে তাঁত শাড়ির পাড়ের ডিজাইন চেঞ্জ করে একটা ভিন্ন প্রকার শাড়ি উদ্ভাবন করেছেন। এটা আদৌতে টাঙ্গাইল শাড়ি নয়।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বিপণন শাখার মহাব্যবস্থাপক অখিল রঞ্জন তরফদার সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ঢাকাই জামদানি, রংপুরের শতরঞ্জি ও শীতলপাটির মতো পণ্যগুলোর জিআই প্রাপ্তির সময় এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ভারতের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, এটা যৌক্তিক নয়। এটার নামই জিওগ্রাফিক্যাল অর্থাৎ ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে এই পণ্যটা স্বীকৃতি পাবে। এখানে ব্যক্তি বিশেষের কোনো বিষয় নেই।