মডেল থানা নামেই মডেল, সংকট নিয়ে চলছে পুলিশি সেবা

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), ডিএফআইডি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সহায়তায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়নে ২০০৫ সালে যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তা অনেকাংশেই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

মডেল থানা নামেই মডেল, সংকট নিয়ে চলছে পুলিশি সেবা

প্রথম নিউজ, ঢাকা: কোনো থানাই মডেল থানা নয়, আবার সব থানাই মডেল থানা- এমন কথা খোদ পুলিশ কর্মকর্তাদের। কারণ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি), ডিএফআইডি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সহায়তায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়নে ২০০৫ সালে যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তা অনেকাংশেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ কার্যক্রমের একটি প্রজেক্ট ছিল ‘মডেল থানা’। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ের পর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে পুলিশ সংস্কার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

মূলত দেড় যুগ আগে পুলিশ সংস্কার কার্যক্রম প্রকল্পের মাধ্যমে রাজধানীসহ সারাদেশে বেশকিছু থানাকে মডেল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল পুলিশি সেবার মান বাড়ানো এবং থানায় নাগরিকসেবা সহজ করা। এ লক্ষ্যে পুলিশের কাজের দক্ষতা ও সুবিধা বাড়ানোর জন্য অপারেশন, ইন্টেলিজেন্স ও ইনভেস্টিগেশনে পৃথক টিম করে কাজ করা হয়। নারীদের জন্য পুলিশি সেবা সহজতর এবং ভুক্তভোগীদের সব ধরনের পুলিশি সেবা দিতে নানা ধরনের কাজ করা হয় এ প্রকল্পের আওতায়।

মডেল থানায় যেসব উপকরণ ও সুবিধা থাকার কথা ছিল সেখানে তা কখনোই ছিল না। অবকাঠামো, গাড়ি ও আবাসনসহ কোনো কিছুতেই থানাগুলো কখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ মডেল থানা হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। পুলিশ সদস্যদের জন্যও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা ছিল না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মডেল থানা এখন শুধু নামে, কিন্তু এসব থানার বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। সারাদেশের থানাগুলোর জন্য এগুলো কোনো আদর্শ মডেল নয়। গাড়ি সংকট, আবাসন সংকট নিয়েই এসব থানা পুলিশি সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এগুলো এখন শুধুই নামে মডেল থানা।

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়নে ২০০৫ সালে নেওয়া প্রকল্পটির আওতায় প্রশিক্ষণসহ নানা কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৭ সাল থেকে। এ কার্যক্রমের একটি ‘মডেল থানা’। মডেল থানা ছাড়াও কমিউনিটি পুলিশিং, নারী পুলিশ নেটওয়ার্ক তৈরিতে সহায়তা, পুলিশ প্রশিক্ষণের জন্য পাঠ্যক্রম, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারগুলো এ প্রকল্পের আওতায় ছিল। পুলিশের আইন সংস্কার নিয়েও কিছু কাজ করা হয়। কাঙ্ক্ষিত সেবা আর অবকাঠামোগত উন্নয়নে দেশব্যাপী থানাগুলোর সামনে আদর্শ উপস্থাপনের জন্য দুই দফায় শুরু হয় এ কার্যক্রম। কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে পুলিশ সংস্কার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তাই মডেল থানা নিয়ে যেসব কার্যক্রম চলমান ছিল, তা-ও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

মডেল থানার বর্তমান হালচাল: সারাদেশে কতটি মডেল থানা রয়েছে তার সঠিক তথ্য বলতে পারেনি পুলিশ হেডকোয়াটার্সের জনসংযোগ দপ্তর। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পাওয়া তথ্যমতে, সারাদেশে ৩৫টির মতো মডেল থানা রয়েছে। তবে পুলিশ ফোনবুক অ্যাপে ৩৮টি মডেল থানার নাম পাওয়া যায়। এরমধ্যে রাজধানীতে রমনা, পল্টন, উত্তরা, মিরপুর- এ চারটি মডেল থানা রয়েছে। তবে অ্যাপে ‘মডেল’ লেখা না থাকলেও চকবাজার থানায় মডেল লেখা আছে। এদিকে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টার থেকে পাঁচটি মডেল থানার কথা জানানো হয়েছে।

সরেজমিনে রাজধানীর মডেল থানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীতে যে পাঁচটি মডেল থানা রয়েছে তার মধ্যে রমনা মডেল থানার কার্যক্রম চলে ভাড়া করা ভবনে। রাস্তার ওপরেই দেওয়ালঘেঁষা ভবন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে কোনো একটি বাসা। তবে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে এক পাশে থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষ অন্য পাশে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষ। মাঝের সরু পথ ধরে যেতে যেতে চোখে পড়বে থানার অন্য কক্ষগুলো। ‘জনবান্ধব থানা ও থানার অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে সহজে মানুষকে পুলিশি সেবা দিতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এরমধ্যে কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলেও পরে সেগুলো এগিয়ে নেওয়া যায়নি। এছাড়া অনেক পরিকল্পনা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বরং প্রকল্পের কাজ ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে গেছে’

বাইরে থেকে দেখে মনেই হবে না এটি মডেল থানার চিত্র। ভবনের ছোট দুটি কক্ষকে থানার হাজতখানা ও একটি কক্ষকে আলামত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দু-তিন তলায় থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের আবাসিক সুবিধা রাখা হয়েছে। কোনো গাড়ি আটক করলে সেটা থানার সামনেই রাখতে হয় কিংবা থানার পুরোনো ভবনে নিয়ে রাখতে হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার গাড়ি ছাড়া আর কোনো গাড়ি রাখার জায়গাও নেই। প্রায় ২০০ পুলিশের মধ্যে নারী আছেন মাত্র ১৩ জন। তাদের অধিকাংশই বাইরে বিভিন্ন জায়গায় থাকেন।

চকবাজার মডেল থানায় গিয়ে দেখা গেছে, থানার সামনে সড়কেই রাখা হয়েছে ডাম্পিং করা কয়েকটি গাড়ি। ভেতরে দরজা দিয়ে ঢুকতেই থানার দেওয়ালঘেঁষে রাখা হয়েছে জব্দ করা মালামাল। অর্থাৎ আলামত রাখার তেমন জায়গা নেই থানায়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষটিও সংকীর্ণ। তার কক্ষের পাশেই থানার একটি হাজতখানা। নারী-পুরুষ উভয়কেই রাখতে হয় একই হাজতখানায়। থানায় রয়েছে ছোট একটি অস্ত্রাগার। যেখানে আলামতও রাখতে হয়।

মডেল থানা এখন শুধু নামে, কিন্তু এসব থানার বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য নেই: কথা বলে জানা গেছে, প্রায় আট লাখ নাগরিকের এই থানা এলাকায় নাগরিক সেবা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তিনজন ইন্সপেক্টর, ২৮ জন সাব-ইন্সপেক্টরসহ মোট ১০৬ জন পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। নারী পুলিশ সদস্য মাত্র আটজন। থানাটিতে সব মিলিয়ে পাঁচটি গাড়ি রয়েছে। শতাধিক পুলিশ সদস্যের জন্য কাজ করার যেমন পর্যাপ্ত জায়গা নেই, আবার তাদের থাকার জন্যও ভালো আবাসন সুবিধা নেই। থানার আবাসন ব্যবস্থা দেখে মনে হবে যেন কোনো বস্তি এলাকা সেটি। একটি আধুনিক মডেল থানার এমন চিত্র যে খুবই বেমানান, তা বলাই যায়। পল্টন মডেল থানায় গিয়ে দেখা গেছে, চারতলা ভবনের নিচতলায় চলছে থানার কার্যক্রম। ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতেই এক পাশে থানার ডিউটি অফিসারের কক্ষ আর অন্য পাশে নারী-শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য হেল্প ডেস্ক। একশোর বেশি পুলিশ সদস্য রয়েছে থানাটিতে। আলামত রাখার জায়গা ও হাজতখানা রয়েছে। ডাম্পিংয়ের জায়গায় রাখা গাড়িগুলোর অধিকাংশই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।

‘ভাড়া ভবনে থানার কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমাদের অফিসারদের অফিসে বসা, গাড়ি রাখার জায়গা, আবাসন সুবিধা কমই রয়েছে। তারপরও নাগরিকদের পুলিশি সেবা দিয়ে যাচ্ছি। মডেল থানা আসলে মডেল নয়, সব থানাই সমান’ রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ভাড়া ভবনে থানার কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমাদের অফিসারদের অফিসে বসা, গাড়ি রাখার জায়গা, আবাসন সুবিধা কমই রয়েছে। তারপরও নাগরিকদের পুলিশি সেবা দিয়ে যাচ্ছি। মডেল থানা আসলে মডেল নয়, সব থানাই সমান।

আদর্শ থানা বলতে কোনো থানা নেই
প্রতিটি বিষয়েরই একটি আদর্শ মান বা বৈশিষ্ট্য থাকে। পুলিশি সেবা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে থানা পুলিশ। থানারও আদর্শ একটি বৈশিষ্ট্য থাকার কথা। কিন্তু পুলিশের বিধি অনুযায়ী আদর্শ থানা বলতে কোনো থানা নেই। রাজধানীসহ সারাদেশে মডেল থানা হিসেবে যেসব থানা দেখা যায় সেগুলোও পুলিশ রিপোর্ট প্রোগ্রাম নামের একটি প্রোগ্রামে কিছু থানাকে মডেল হিসেবে ঘোষণা দিয়ে কাজ করা হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপ-প্রধান তথ্য অফিসার) এ কে এম কামরুল আহছান  বলেন, আদর্শ থানা বলতে কোনো থানা নেই। সব থানাই সমান। কোনো থানাই মডেল নয়। পুলিশ রিপোর্ট প্রোগ্রাম থেকে কয়েকটা থানাকে মডেল ঘোষণা দিয়ে তারা কাজ করেছে। এখন সব থানাই সমান। আদর্শ বা মডেল থানার কোনো নির্দেশনা নেই। সব থানায়ই বিভিন্ন ধরনের ভবন হচ্ছে।

আধুনিক সুবিধা দিয়ে মডেল থানার প্রকল্প করা হয়েছিল। বর্তমানে থানাগুলোতে লোকবল বাড়লেও কারিগরি সহায়তা সেভাবে বাড়েনি। পুলিশ সদস্যরা জানান, থানায় পর্যাপ্ত গাড়ি নেই। আবাসন সংকট থাকায় অনেকে কম ভাড়ায় নিম্নমানের বাসায় থাকতে বাধ্য হন। এমনকি কম টাকায় বাসাভাড়া পেতে থানা এলাকা থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়। তারা মনে করেন, কারিগরি সহায়তা, আবাসন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে নানাবিধ সংকট দূর করে পুলিশি সেবা নিশ্চিত করা জরুরি।

পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ও প্রত্যাশা বেড়েছে। তাই মানুষ প্রথমেই যে কোনো ধরনের সেবা নিতে থানায় আসে। কিন্তু সব ধরনের সেবা থানা থেকে পাওয়া যায় না। মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন জাগো নিউজকে বলেন, থানায় ৭০ শতাংশ মানুষই আসেন সাইবার অপরাধের অভিযোগ নিয়ে। মানুষ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারিত হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়েই বেশিরভাগ মানুষ থানায় আসে। কিন্তু থানায় এ ধরনের সেবা না থাকায় তাদের সাইবার ইউনিটে পাঠাতে হয়।

সাইবার অপরাধের জন্য সাইবার ইউনিট করা হয়েছে। সাইবার অপরাধের শিকার কোনো ব্যক্তি থানায় গেলেও সেই সেবা থানায় নেই। তাই ভুক্তভোগীদের সাইবারে পাঠায় থানা পুলিশ। ওসি মহসীন বলেন, থানায় সাইবার অপরাধের অভিযোগ বিষয়ে কোনো ব্যক্তি সেবা নিতে এলে একটা জিডি করিয়ে তাকে গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) পাঠিয়ে দেই।

পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী  বলেন, জনবান্ধব থানা ও থানার অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা তৈরি করে সহজে মানুষকে পুলিশি সেবা দিতে নানান পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এরমধ্যে কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলেও পরে সেগুলো এগিয়ে নেওয়া যায়নি। এছাড়া অনেক পরিকল্পনা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বরং প্রকল্পের কাজ ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে গেছে। তিনি বলেন, তথ্য ও সেবা পাওয়া, আইনের আশ্রয় পাওয়ার নিশ্চয়তাসহ পুলিশি সেবা প্রাপ্তির বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখতে ‘মডেল থানা’ প্রকল্পটি নেওয়া হয়। কর্মকর্তাদের ট্রেনিং, মানসিক দৃঢ়তা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তদারকির অভাবে দেশের বেশিরভাগ মডেল থানাই কাঙ্ক্ষিত মান ধরে রাখতে পারেনি। থানাগুলোকে পুলিশের সব ধরনের সেবা দেওয়ার উপযোগী করে তুলতে হবে। তাহলেই ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে সহজে যে কোনো সেবা পাবেন।