জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, গণভোগান্তি চরমে, ঘুমিয়ে আছে দক্ষিণ সিটি

ঢাকা দক্ষিণ সিটি রাজস্ব ভাগাভাগিসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই সেবা দিচ্ছে না।

জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, গণভোগান্তি চরমে, ঘুমিয়ে আছে দক্ষিণ সিটি

প্রথম নিউজ, অনলাইন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ভিসা আবেদনসহ ১৯টি নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি রাজস্ব ভাগাভাগিসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই সেবা দিচ্ছে না। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা। নির্ধারিত  আঞ্চলিক কার্যালয়ে দিনের পর দিন ঘুরেও কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না নাগরিকরা। এ বিষয়ে ভোগান্তি নিরসন করতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে ঢাকা উত্তর সিটির নাগরিকরাও ভুগছেন এই সেবা নিয়ে। বলা হচ্ছে সার্ভার ডাউনের কারণে ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন না সিটির নাগরিকরা। 

ভুক্তভোগী নাগরিকদের অভিযোগ, নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারছেন না এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার কারণে। কবে নাগাদ সুবিধা মিলবে তারও কোনো উত্তর নেই দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তাদের কাছে। নাগরিকদের এভাবে সেবা বঞ্চিত করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান। তিনি বলেন, এটি হচ্ছে নাগরিকদের অধিকার। সেখান থেকে বঞ্চিত করার কোনো সুযোগ নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে নাগরিকরা ভুগবে কেন? যদি তারা বন্ধ রেখে থাকে তাহলে গুরুতর অন্যায় করা হচ্ছে। 

সরজমিন দক্ষিণ সিটির ১৪, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য নির্ধারিত অঞ্চল-৩ এর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা রেজিস্ট্রেশন সহকারী হাসনা রহমান তার চেয়ারে বসে অলস সময় পার করছেন। সেবাভোগী কেউ আসলে তাকে জানিয়ে দিচ্ছেন-‘সার্ভারে সমস্যা। আপাতত নিবন্ধনের কাজ বন্ধ রয়েছে।’ হাসনা রহমান বলেন, ‘গত ৩ মাস ধরে আমাদের এই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সার্ভারে ঢুকতে পারি না। ঠিক কবে এই সমস্যার সমাধান হবে তাও বলতে পারবো না। কয়েকদিন আগে এক মহিলা মেয়র স্যারের অনুমতি নিয়ে আসছিল। তিনদিন ঘুরে তারপর তার বাচ্চার জন্মসনদটা দিতে পেরেছি। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে প্রতিদিন মানুষ আসছে। আর তাদের বুঝিয়ে ফেরত পাঠাতে মাঝে মাঝে ঘাম ছুটে যায়।’ তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ গত ২১শে মে পর্যন্ত আমরা সার্ভারে কাজ করতে পেরেছি। এরপর আর পারেনি। তবে ৭ই জুন পর্যন্ত কিছু ফাইল জমা রাখা হয়েছে। সেগুলো এখনো ওভাবেই পড়ে আছে।’ 

দক্ষিণ সিটির ৭, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত অঞ্চল-৫ গঠিত। সরজমিন সেখানে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। জন্ম- মৃত্যু সনদ নিতে অনেকে আসলেও তাদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আঞ্চলিক কার্যালয়ের বাইরে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের কাজ হয় গুলিস্থানস্থ নগর ভবনেও। সেখানে গিয়েও দেখা যায় একই অবস্থা। নগর ভবনে সেবা নিতে আসা বৃটিশ পেট্রোলিয়ামের মাস্কট ব্রাঞ্চে চাকরিরত বদরুজ্জামান বাবু জানান, আমরা মূলত দেশের বাইরে থাকি। এখন আমার বোন ও মায়ের ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করা হবে। আমরা যে মায়ের সন্তান এজন্য ইউএস অ্যাম্বাসি থেকে তাদের জন্মনিবন্ধন চেয়েছে। কিন্তু আমার মায়ের জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে আমার বোনের জন্মনিবন্ধনে কিছুটা অসঙ্গতি রয়েছে। যার কারণে মায়ের জন্ম সনদের সংশোধন প্রয়োজন। তা না হলে পুরো প্রসেসটাই বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু গত এক মাস ধরে ঘুরে ঘুরেও আমার কাজটা সম্ভব হয়নি। কবে হবে তাও জানি না। 

সবাই বলছেন- সার্ভারে সমস্যা। নাফিজা রহমান নামে একজন সেবা গ্রহীতা তার ১ বছর বয়সী ছেলের জন্মনিবন্ধন করানোর জন্য গত এক মাস ধরে সিটি করপোরেশনে ঘুরছেন। কিন্তু সেখান থেকে তাকে বলা হয়েছে, মেয়রের নির্দেশে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। কবে চালু হবে, কারও জানা নেই। এমনই একজন জোবায়ের রহমান। তার বাচ্চা অসুস্থ থাকায় তাকে ডাক্তার দেখাতে ভারত নিয়ে যাবেন। তার পাসপোর্ট থাকলেও ৪ বছর বয়সী সন্তানের পাসপোর্ট নেই। এই পাসপোর্ট জন্ম সনদ ছাড়া সম্ভব নয়। তাই জন্ম সনদ নিতে গত ১৫ দিন ধরে ঘুরছেন সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কার্যালয়ে। ভুক্তভোগী বাবা জোবায়ের রহমান বলেন, আমার সব প্রসেস শেষ। শুধুমাত্র একটা জন্ম সনদের জন্য আজ আমার বাচ্চার জীবন সংশয় দেখা দিয়েছে। আমার ছেলের কিছু হলে এর দায় কে নেবে? মায়ের মৃত্যু সনদ নিতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা তারক দত্ত বলেন, আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছে গত জুন মাসে। কিন্তু এখনো মায়ের মৃত্যু সনদটা হাতে পাইনি। মায়ের মৃত্যু সনদ ছাড়া তার ব্যাংকে জমানো টাকা ওঠানোসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। 

এ বিষয়ে ঢাকা সিটির অঞ্চল-১ এর জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা রেজিস্ট্রেশন সহকারী মো. গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমাদের কাছে প্রতিনিয়ত লোক আসছে। তাদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। কিন্তু আমরা যে সার্ভারে কাজ করি সেটা বন্ধ রয়েছে। প্রায় ৩ মাস ধরে কোনো ভাবেই সার্ভারে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে মানুষকে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। কবে এই সমস্যার সমাধান হবে সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ নিয়ে মেয়র মন্ত্রী মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আলোচনা চলছে। শিগগিরই হয়তো সমাধান হয়ে যাবে।

রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মো. রাশেদুল হাসান বলেন, আমাদের সার্ভারের কোনো সমস্যা নেই। সারা দেশে কাজ হচ্ছে। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা থাকলে অন্যরা কীভাবে কাজ করতেন। যারা সার্ভারে সমস্যার কথা বলছেন এটা মূলত তাদের সমস্যা। তারা আসলে কী কারণে জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন বন্ধ রেখে মানুষকে ভোগান্তিতে রেখেছেন তা আমাদের জানা নেই। 

ওদিকে উত্তর সিটির নাগরিকদের যে ভোগান্তি হচ্ছে তা মূলত সার্ভার ডাউনের কারণে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, সিটি করপোরেশন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সমস্যা যা হচ্ছে সার্ভার সমস্যার কারণে।  ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকা প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ.কে.এম শফিকুর রহমান জানান, সার্ভারে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে জনভোগান্তি কমাতে আমাদের কার্যক্রম চালু রেখেছি।