কাজেই এলো না কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড
কৃষি বিভাগের অবহেলা আর অযত্নে দীর্ঘদিন অকেজো পড়ে রয়েছে এসব বোর্ড। কোথাও চুরি হয়ে গেছে, রেইন গেজ মিটার ও সৌর বিদ্যুতের প্যানেল। এমনকি অনেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
প্রথম নিউজ,গাইবান্ধা: বৃষ্টি, তাপমাত্রা, আদ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, আলোকঘণ্টা সংক্রান্ত নানাবিধ তথ্য কৃষকদের মাঝে আগাম সরবরাহের জন্য সারাদেশের মতো উত্তরের জনপদ গাইবান্ধার সাত উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয় কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড। কিন্তু কৃষি বিভাগের অবহেলা আর অযত্নে দীর্ঘদিন অকেজো পড়ে রয়েছে এসব বোর্ড। কোথাও চুরি হয়ে গেছে, রেইন গেজ মিটার ও সৌর বিদ্যুতের প্যানেল। এমনকি অনেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষা ও সঠিক সময়ে চাষাবাদের জন্য আগাম তথ্য দিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ প্রকল্প গ্রহণ করে কৃষি সম্প্রসারণ ও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয় কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড ও রেইন গেজ মিটার। এটি পরিচালনার জন্য ওই সময় প্রত্যেক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে দুইদিন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সেইসঙ্গে আবহাওয়া বিষয়ক সফটওয়্যারসহ প্রত্যেককে একটি করে ট্যাব দেওয়া হয়। সফটওয়্যার বা ওয়েবসাইট থেকে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য সরকারিভাবে প্রতিমাসে ইন্টারনেট প্যাকেজ দেওয়া হচ্ছে। তবুও মুখ থুবড়ে পড়েছে আবহাওয়া কৃষি পূর্বাভাস বোর্ড।
সম্প্রতি গাইবান্ধার সাত উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, কৃষি আবহাওয়া বোর্ডগুলো ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে নামমাত্র স্থাপন করা হয়েছে। এ বোর্ড থেকে কৃষকদের নিয়মিত কৃষি আবহাওয়া পরামর্শ সেবা পাওয়ার কথা থাকলেও তা পাচ্ছেন না। অযত্নে আর অবহেলায় পড়ে আছে ডিসপ্লে বোর্ড, সোলার প্যানেল ও রেইন গেজ মেশিনগুলো। কোথাও কোথাও আবার খুলে রাখা হয়েছে। ডিসপ্লে বোর্ডে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আদ্রতার হার, বায়ুপ্রবাহ, দিনের আলো কতক্ষণ থাকবে ও ঝড়ের পূর্বাভাসসহ ১০টি তথ্য ছক আছে। এই বোর্ড থেকেই তিন দিন আগের ও তিন দিন পরের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে পারবেন কৃষকরা। কিন্তু এসব বোর্ড স্থাপনের পর থেকেই নেই কোনো কার্যক্রম।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের একটি কক্ষের ভেতরে দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড। বোর্ডে কোনো তথ্য হালনাগাদ করা নেই। জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য নিচে ডানপাশে কৃষি কর্মকর্তাদের মোবাইল নম্বর থাকার কথা থাকলেও সেখানে কোনো মোবাইল নম্বর উল্লেখ নেই। শুধু ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ নয়, রামজীবন, দহবন্দ, বেলকা, তারাপুর, কামারজানি, মোল্লারচর, লক্ষ্মীপুর, নলডাঙ্গা, দামোদরপুর, মহিমাগঞ্জ, বেতকাপা, গুমানিগঞ্জ, রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নসহ জেলার সাত উপজেলার ৮১ ইউনিয়নের একই চিত্র। অনেক ইউনিয়ন পরিষদে কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ডের কোনো অস্তিত্বই নেই।
কৃষকরা জানান, স্থাপনের পর থেকে ইউনিয়ন পরিষদের আবহাওয়া বোর্ডের চাকা একদিনও ঘোরেনি। এখান থেকে কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর ফসলের ক্ষতি হলেও এ বোর্ড কোনো কাজে আসছে না। ফলে সরকারের এ প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এতে করে একদিকে যেমন কৃষকরা এ প্রকল্পের সুফল পাচ্ছেন না অন্যদিকে নষ্ট হতে চলেছে সরকারের অর্থ। স্থাপিত বোর্ডগুলো সংস্কার করে দ্রুত তথ্য হালনাগাদ করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোমাট এলাকার কৃষক আজাদুল ইসলাম বলেন, ঝড়-বৃষ্টিতে প্রতি বছরই আমাদের ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। কিন্তু পরিষদ থেকে আগাম কোনো তথ্য পাই না। আগাম তথ্য পেলে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া যেত। সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, কৃষকদের মাঝে আবহাওয়ার আগাম তথ্য দেওয়ার জন্য সরকার এমন একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে, অথচ আমরা জানি না। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছে।
ইউনিয়ন পরিষদে ‘কৃষি আবহাওয়া তথ্য’ কখনো বোর্ড দেখেননি দাবি করে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল আলম সরকার রেজা জাগো নিউজকে বলেন, কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড ইউনিয়ন পরিষদে নেই। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এ ধরনের কোনো কার্যক্রমও দেখিনি। এ বিষয়ে আমাকে কৃষি বিভাগ থেকে কখনো কিছু জানায়নি। এটি থাকলে এলাকার কৃষকরা উপকৃত হতো।
কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোয়ার আলম সরকার বলেন, আবহাওয়া তথ্য বোর্ডের তথ্য কোনোদিনই কৃষি কর্মকর্তারা হালনাগাদ করেননি। নিয়মিত ব্যবহার না হওয়ায় এগুলো নষ্ট হয়েছে। কৃষকদের মাঝে আগাম আবহাওয়া পূর্বাভাস জানানোর জন্য আধুনিক তথ্যসেবা বোর্ড চালুর দাবি জানাচ্ছি। নামপ্রকাশ না করার শর্তে একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড স্থাপনের সময় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদেরকে দু’দিনের আবাসিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নিয়মিত হালনাগাদের জন্য একটি করে ট্যাবও দেওয়া হয়। কিন্তু বোর্ড স্থাপনের পর থেকে ডিসপ্লেতে সমস্যা। সংস্কারের জন্য পরবর্তীতে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এজন্যই সরকারের এ প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে।
তবে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. রাশিদুল কবির দাবি করেন, কৃষকদের আগাম আবহাওয়া তথ্য প্রদানের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে তথ্য বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। এসব নিয়মিত হালনাগাদ করা হয়। নানাবিধ কারণে অধিকাংশ যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে আছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে কৃষকদের আগাম কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য পূর্বাভাস বোর্ড ও রেইন গেজ মিটার স্থাপন করা হয়েছিল। এখানে প্রতিদিনের তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং কৃষকদের করণীয় কী ওয়েবসাইট থেকে নিয়ে আমাদের বোর্ডে লেখার কথা। এটি সম্পূর্ণ ম্যানুয়াল পদ্ধতি। স্থাপনের সময় ঠিকই ছিল। পরবর্তীতে গুরুত্ব না দেওয়ায় এখন কম ব্যবহার হয়। কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস বোর্ড থেকে নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য প্রদান নিশ্চিত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।