আমার কলিজার টুকরাকে কে গুলি মারলো?

আমার কলিজার টুকরাকে কে গুলি মারলো?

প্রথম নিউজ, কুমিল্লা: আমার কলিজার টুকরা ছেলেটা কই, আমার নিমাই চানরে কে গুলি করে মারলো! আমার বুকটা খালি করলো কারা? তাদের কি একটুও বুক কাঁপলো না! আমার ছেলেরে কেউ আইন্না দাও, আমি জড়াই ধরি। না জানি আমার সোনার চানের কতো কষ্টে দম গেছে, আহারে কোন পাষণ্ড আমার নিরীহ ছেলেরে গুলি করলো, আমার চিকিৎসার খরচ আর কে দিবে। আমার তো সব শেষ হয়ে গেছে। গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে এভাবেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন ঢাকায় গুলিতে নিহত কাদির হোসেন সোহাগের মা নাছিমা বেগম।

গত ২০শে জুলাই শনিবার রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় সংঘর্ষ ও গোলাগুলির সময় রাত ৮টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয় সোহাগ (২৪)।  কয়েকজন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত ৩টার পর তার মৃত্যু হয়। নিহত সোহাগ দেবিদ্বার উপজেলার ভানী  ইউনিয়নের সূর্যপুর গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে। সে ঢাকার গোপীবাগ এলাকায় একটি মেসে থাকতো। পরদিন রোববার সকাল ১১টার দিকে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি সূর্যপুরে নিয়ে আসে। পরে দুপুরে জানাজা শেষে তাকে বাড়ির পাশে একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়। মা নাছিমা বেগম ছেলে সোহাগের ছবি দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ২২ বছর ধরে স্বামী নেই, সোহাগের যখন তিন বছর তখন আমার স্বামী ঢাকা থেকে নিখোঁজ হয়, আর ফিরে আসেনি।

সে এখনও বেঁচে আছে না মরে গেছে আমরা কেউ জানি না। তবুও আমরা ধরে নিছি তিনি আর বেঁচে নেই। স্বামী নিখোঁজের পর সংসারের হাল ধরতে সোহাগ ও দেড় বছরের সহিদুল ইসলামকে নিয়ে ঢাকায় মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেছি। পাঁচ বছর আগে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। সোহাগ লেখাপড়া বন্ধ করে সংসারের হাল ধরে। ছোট ছেলে সহিদুল মাদ্রাসায় ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। অভাব অনটনে তার লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়,  সে এখন এক বই বাঁধাই কোম্পানিতে কাজ করে।  আমার চিকিৎসা ও সংসারের হাল ধরতে সোহাগ একটি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিতে ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করতো। গত ১০/১২ দিন আগে তার চাকরিটা চলে যায়। পরে নতুন আরেকটি কোম্পানিতে চাকরির কথা হয়। ১৫ই জুলাই বাড়িতে এসে কাগজপত্র নিয়ে নতুন কোম্পানিতে জমা দেয়। এরপর ৪/৫দিনের মধ্যে নতুন চাকরিতে যোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু রোববার আমার ছেলের বুকে গুলি লাগে।  আমি এখন কি নিয়ে বাঁচবো? আমার ছেলে শেষবার আমাকে ফোন করে  বলেছিল, ‘মা ঢাকায় অনেক গোলাগুলি হচ্ছে, অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে’ এ কথা শুনে আমার বুক কেঁপে ওঠে, আমি বলি বাবারে তুই রুম থেকে বের হইস না, না মা আমরা সব রুমমেট এক সাথে আছি বের হইনি। তবে মা মেসে কোনো খাবার নেই, আমার কাছেও কোনো টাকা নেই, তুমি যদি পারো আমার বিকাশে ৫০০ টাকা দিও। আর তুমি ঠিকমতো ওষুধগুলো খাইও। পরে আমি আমার ছেলের নম্বরে ৫০০ টাকা পাঠাই। ওই টাকা  নিয়ে সন্ধ্যায় নাস্তা আনতে বের হয়। আমি আমার ছেলের হত্যার বিচার কার কাছে চাইবো। কেউ কি আমার ছেলেকে ফিরায়ে দিতে পারবে বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন মা নাছিমা বেগম।    

সোহাগের ছোট ভাই সহিদুল ইসলাম বলেন, ভাই গুলি খাওয়ার পর তার বন্ধুরা আমাকে ফোনে জানায়। আমি রাত ৩টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে  পৌঁছাই, গিয়ে দেখি ভাইয়ের বুকে ব্যান্ডেজ করা। আমাকে দেখে ভাই বলে, তুই এত রাতে এখানে কেন আসছিস। তুই মা’কে দেখে রাখিস। এই কথা বলে রাত ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে ভাই মারা যায়। ভাই একমাত্র আমাদের সংসার চালাতো। বাবা ও ভাই হারিয়ে আমরা আজ নিঃস্ব হয়ে গেলাম।  

নিহত সোহাগের চাচা এখলাছুর রহমান শানিক বলেন, ২২ বছর আগে সোহগের বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর তার মা বিভিন্ন বাসা বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের বড় করেছেন। তার মা অসুস্থ হয়ে গেলে তার চিকিৎসার খরচ ও সংসারের হাল ধরে সোহাগ। নতুন একটি কোম্পানিতে চাকরির কথা চলছিল তার। দুই একদিনের মধ্যে সেখানে যোগ দেয়ার কথা ছিল। সেটা আর হলো না। ছোটবেলা থেকে বাবার আদর পায়নি ছেলেটা, অভাব-অনটনে বড় হইছে। ধরতে গেলে ওরা এতিম ছিল। একটা গুলি এই পরিবারটাকে একেবারে পথে বসিয়ে দিলো।  

ভানী ইউপি চেয়ারম্যান হাজী জালাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ছেলেটা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। সংসারটা সেই চালাত। ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা যায়।  এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। আমি পরিষদ থেকে তার মা’কে বিধবা ভাতার কার্ড করে দেবো। দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইউএনও নিগার সুলতানা বলেন, এটি একটি মর্মান্তিক মৃত্যু। তার পুরো পরিবার সম্পর্কে আমি খোঁজ-খবর রাখছি। সরকারিভাবে সোহাগের মা’কে সাহায্য- সহযোগিতা করা হবে।