৩০ শতাংশেরও কম নার্স দিয়ে চলছে হাসপাতালের সেবা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ২৩ জন নার্স থাকার কথা। সংস্থার নিয়ম অনুসারে হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসক এবং নার্সের অনুপাত হতে হবে এক অনুপাত তিন (১:৩)। অর্থাৎ একজন চিকিৎসকের সাথে অন্তত ৩ জন নার্স থাকতে হবে।

৩০ শতাংশেরও কম নার্স দিয়ে চলছে হাসপাতালের সেবা

প্রথম নিউজ, ঢাকা: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এখনো সন্তুষ্ট হতে পারেন না অধিকাংশ মানুষ। চিকিৎসকের পর স্বাস্থ্যসেবায় নার্সরা গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশের হাসপাতালে নার্সের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। যা আছে তাদের বড় অংশ দক্ষ ও প্রশিক্ষিত না হওয়ায় কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ২৩ জন নার্স থাকার কথা। সংস্থার নিয়ম অনুসারে হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসক এবং নার্সের অনুপাত হতে হবে এক অনুপাত তিন (১:৩)। অর্থাৎ একজন চিকিৎসকের সাথে অন্তত ৩ জন নার্স থাকতে হবে।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল-বিএমডিসির তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের মতো। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ডা: সামিউল ইসলাম বলেন, এর মধ্যে সরকারি চিকিৎসক সংখ্যা প্রায় ৩৪ হাজার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাক্তার অনুপাতে দেশে নার্স থাকার কথা সোয়া তিন লাখের উপরে। কিন্তু দেশে নার্স আছে প্রায় ৮৪ হাজার। অর্থাৎ দেশে প্রয়োজনের তুলনায় নার্স রয়েছে ৩০ শতাংশেরও কম। এক কথায় নার্সদের সংখ্যা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসহ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এখনো অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।

এ বিষয়ে নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) মো: নাসির উদ্দিন বলেন, দেশে বর্তমানে সরকারি বেসরকারি মিলে নিবন্ধিত নার্স সংখ্যা প্রায় ৮৪ হাজার। দেশে যে পরিমাণ চিকিৎসক আছেন তার তিন গুণ নার্স থাকার কথা। সেটা নেই। নার্স সঙ্কটে সামাল দিচ্ছেন কেমন করে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, সামাল দেয়া খুব কঠিন হচ্ছে। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। যেমন এখন ডেঙ্গু প্রকট আকার ধারণ করছে। যারা (নার্স) আছেন, তারা দিন রাত কাজ করছেন। অন্যদিকে, বদলি-পদায়ন নিয়েও অনেক চাপ থাকে। মো: নাসির উদ্দিন বলেন, আমরা (নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদফতর) ১০ হাজার নার্সের পদ সৃষ্টির প্রস্তাবনা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এই প্রস্তাব তারা (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সেখান থেকে অনুমোদন হয়ে ফিরে আসলে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশে রোগী বাড়ছে। হাসপাতাল বাড়ছে। কিন্তু নার্স সংখ্যা সেভাবে বাড়ছে না। দীর্ঘদিন ধরেই নার্স সঙ্কট নিয়ে চলতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। ফলে কাজের বাড়তি চাপ নিয়েই হাসপাতালগুলোয় সেবা দিচ্ছেন নার্সরা। এর মধ্যেও সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈরিতা, উপযুক্ত পরিবেশের অভাব, রোগীর স্বজনদের দুর্ব্যবহার, প্রাতিষ্ঠানিক অস্বচ্ছতা, পদোন্নতির ঘাটতিসহ কর্মক্ষেত্রে নানা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় তাদের। পেশাগত জীবনে এমন নানামুখী চাপ প্রভাব ফেলছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও। স্বাস্থ্য খাতের অপরিহার্য এ কর্মী বাহিনীর অধিকাংশকেই এখন নানামুখী মানসিক স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, স্বাস্থ্যসেবা একটি দলগত প্রচেষ্টা। এ দলের প্রধান চিকিৎসক আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন নার্স। এখানে চিকিৎসকরা রোগের ধরন এবং কী ধরনের চিকিৎসা লাগবে সেটি নির্ধারণ করেন। আর নার্সরা সে নির্দেশনা অনুযায়ী সেবা প্রদান করেন। এজন্য নার্সদের পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি রোগীর সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্য এবং সামাজিকভাবে সুস্থ জীবনযাপনের অধিকারী হতে হবে। এ মানসিক সুস্বাস্থ্য বিঘিœত হলে তারা সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এ কারণে পৃথিবীর সব দেশে চিকিৎসক ও নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়।

২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্যনুযায়ী, দেশের ৮৬ শতাংশ নার্স অনুপযুক্ত পরিবেশে কাজ করছেন। কোলাহলমুখর, স্বল্প আলো, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও অপর্যাপ্ত বায়ুপ্রবাহের মধ্যে দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছেন তারা। এর পরেও কর্মজীবনে পদোন্নতি পান না ৭০ শতাংশ নার্স। পদোন্নতি না পাওয়া এসব স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন ১০-২০ বছর ধরে। এর সাথে সাথে অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে তাদের মধ্যে পেশাগত চাপ তৈরি হয়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।

বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) রাশিদা আক্তার বলেন, ‘আশা করি পাঁচ বছরের মধ্যে জনসংখ্যার বিপরীতে নার্সের ঘাটতি কিছুটা কমে আসবে। এছাড়া নার্সিংয়ে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করা হয়েছে, যা প্রশাসনিক অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ কারিকুলাম চালু হলে নার্সরা তাদের নিজেদের ও অন্যের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন।’

বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএনএ) মহাসচিব জামাল উদ্দিন বাদশাহ বলেন, দেশে প্রায় ৮৪ হাজার নিবন্ধিত নার্স রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪ হাজার সরকারি। তিনি বলেন, রোগীর উন্নত বা মানসম্মত সেবার জন্য নার্স সংখ্যা বাড়ানো দরকার। নার্সদের দক্ষতা আগের চেয়ে বাড়ছে উল্লেখ করে কলেজ অব নার্সিং, মহাখালী-ঢাকার সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মফিজ উল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, আগে এসএসসি পাস করে নার্সিংয়ে ভর্তি হতো। এখন এইচএসসি পাস করে আসে। যারা সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড তারা ৪ বছরের অনার্স কোর্স করে। অন্যান্য ব্যাকগ্রাউন্ডের যারা, তারা তিন বছরের ডিপ্লোমা করে। তিনি বলেন, বর্তমানে নার্স সংখ্যা ১ লাখের নিচে। ডাক্তারের তুলনায় দেশে এখনো ন্যূনতম ২ লাখ নার্স লাগবে।

বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিভার ভিউ নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা এই বিশেষজ্ঞ বলছেন, নার্সদের এখন এন্ট্রি পোস্ট দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা। তাদের সামাজিক মর্যাদা বেড়েছে। ডাক্তারদের পরেই হাসপাতালে নার্সদের অবস্থান। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে নার্সদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদা সত্ত্বেও নার্সরা যেতে পারছেন না, কারণ ইংরেজিতে অতটা দক্ষ নয় তারা। তবে, এখন আমরা নার্সদের ভাষাগত ও টেকনোলজির প্রতি জোর দেয়া হয়েছে।

নার্সরা এখন অনেক এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করেন তিনি বলেন, দেশে পিএইচডি ও মাস্টার্স করা নার্স সংখ্যা এখন কমপক্ষে দেড় হাজারের মতো। সমস্যা হলো তাদের পদোন্নতিটা ঠিক মতো হয় না। ১৫-২০ বছরে একই পদে তারা পড়ে থাকে। নার্সিং শিক্ষার মান আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে উল্লেখ করে ড. মফিজ উল্লাহ বলেন, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট আছে। এর মধ্যে সরকারি প্রায় ১৫০টি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে প্রফেসর, এসোসিয়েট প্রফেসর পদ ২-৩ বছর আগে সৃজন করা হয়েছে, কিন্তু এখনো তা খালি পড়ে আছে। তিনি মনে করেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নার্সরা এখনো যেতে পারে নাই। চেষ্টা আছে। বলতে পারেন যে, নার্স ও রিসোর্স সঙ্কট, সুশিক্ষিত নার্স, প্রশিক্ষিত নার্সের অভাব রয়েছে। এ কারণে রোগীরা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না। নার্স সংখ্যা আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেলেও গুণগত সেবার মান বাড়েনি।