সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে ৩৫% পরিবার

বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘কেমন আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ?’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল এবং গরিব মানুষের আয়-ব্যয় চিত্র তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে ৩৫% পরিবার
সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে ৩৫% পরিবার

প্রথম নিউজ, ডেস্ক: বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। বাজারের আগুনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি চড়ছে; উঠেছে প্রায় ৯ শতাংশে। মূল্যস্ফীতির এই চাপে দেশের ৭৪ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার ধার করে চলছে বলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেমের এক জরিপে উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে এসব পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ১৩ শতাংশ কিন্তু তাদের আয় বাড়েনি। দেশের গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর করা এই জরিপে যেসব পরিবার অংশ নিয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে অর্থনৈতিক চাপে তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতির জন্য বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বাজার অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।

সানেমের জরিপে যারা অংশ নিয়েছেন তাদের বেশির ভাগ কোনো না কোনো অপ্রতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। তাদের মাসিক আয় ১৪ হাজার টাকার বেশি নয়। তাদের ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ ওএমএস ও টিসিবির তালিকাভুক্ত এবং সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সুবিধাভোগী। বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘কেমন আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ?’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল এবং গরিব মানুষের আয়-ব্যয় চিত্র তুলে ধরেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি গরিবদের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা জানতে গত ৯ থেকে ১৮ মার্চ সারা দেশে আটটি বিভাগের প্রতিটিতে ২০০ জন করে মোট ১ হাজার ৬০০ নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এই জরিপ চালানো হয়। জরিপে অংশ নেয়াদের অর্ধেক বাস করেন বিভাগীয় শহরে, বাকিরা উপজেলা শহরের আশপাশে। এদের মধ্যে ৪৫৬ জন সরকারের খোলাবাজারে খাদ্য বিক্রি কর্মসূচি ওএমএস ও ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির সুবিধাভোগী। বাকিদের সবাই অন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় সরকারের কাছ থেকে নগদ টাকা পান।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি এই ছয় মাসের তথ্য নেয়া হয়েছে। সানেম বলছে, দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেড়েছে না কমেছে, তা তুলে ধরার জন্য এই জরিপ করা হয়নি। জরিপ করা হয়েছে মূল্যস্ফীতির চাপে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চাপের বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের সামনে নিয়ে আসার জন্য।

সানেমের জরিপের তথ্য বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় বাড়তে থাকায় গত ছয় মাসে যে ৭৪ শতাংশ পরিবার ধার করে চলেছে, তাদের ধার করা বন্ধ হয়েছে বা বন্ধ হবে, এমন পরিস্থিতি এখনো আসেনি। বরং পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে যে, আগামী ছয় মাসে তাদের আরও ধার করতে হবে। জরিপ বলছে, ৩৫ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে, আর সঞ্চয় বিমুখ হয়েছে ৫৫ শতাংশ পরিবার।

গত ছয় মাসে ধারের উৎস হিসেবে ৪৫ শতাংশ পরিবার বেছে নিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠান। সানেম মনে করে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ সুদের দুষ্টচক্রে পড়ে এবং পরে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। ধার করার জন্য আরও অনেক পথ খুঁজছে মানুষ। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ পরিবার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। সমবায় সমিতি থেকে ধার করছে ২৩ শতাংশ পরিবার। এ ছাড়া ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়েছে যথাক্রমে ১৪ ও ৩ শতাংশ পরিবার।

সানেম বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাবারের খরচ মেটাতে মানুষ এখন ব্যাপক কাটছাঁট করে চলছে। জরিপে অংশ নেয়া ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে, তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। যেমন ছয় মাস আগেও যেসব পরিবারে মাসে চারবার মুরগি খেত, এখন তারা দুইবার মুরগি খায়। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। এ ছাড়া ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে।

খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং সেবায়ও নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে খরচ কমিয়েছে। বিশেষ করে পোশাক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। জরিপের তথ্য বলছে, শহরের নিম্ন আয়ের পরিবার খাদ্য কিনতে বেশি কাটছাঁট করছে। গ্রামের পরিবারগুলো খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে খরচ কমিয়েছে বেশি।

সানেমের জরিপে উঠে এসেছে, ঘরে খাবার আছে কি না, তা নিয়ে নিম্ন আয়ের পরিবারে আগের তুলনায় উদ্বেগ বেড়েছে। ফলে খাবারে বৈচিত্র্য কমেছে। খাদ্যতালিকায় থাকছে মাত্র কয়েকটি পদ। ৩৭ শতাংশ পরিবার বলেছে, তাদের এখন মাঝেমধ্যে কোনো একবেলা খাবার না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় খাবার কম খাচ্ছে বলে মনে করে ৭১ শতাংশ পরিবার।

জরিপকারীদের কাছে ১৮ শতাংশ পরিবারের লোকজন দাবি করেছেন যে, এই ছয় মাসে এমন কিছুদিন গেছে, যেদিন তাদের পুরো দিনও না খেয়ে থাকতে হয়েছে। খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিতে হচ্ছে এসব মানুষের। যার কারণে আগের থেকে কম দামি মাছ-মাংস খেতে হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তার ভয় বেশি শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারে।

জরিপে অংশ নেয়া ৫৬ শতাংশ পরিবার মনে করে, আগামী ছয় মাসে তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। ৪১ শতাংশ পরিবার এটাও বলছে, ভবিষ্যতে তাদের ভিক্ষা বা শর্তহীন সাহায্য নিয়ে চলতে হতে পারে। টিকে থাকার জন্য শহর থেকে গ্রামে যেতে চায় বেশির ভাগ মানুষ। বর্তমানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে জরিপে অংশ নেয়া অধিকাংশ মানুষ বলেছেন, সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সানেম বলছে, ময়মনসিংহ, উত্তরাঞ্চল ও সিলেটের নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার ভয় বেশি।

সানেম আরও বলছে, খাবার জোগাড় করতে জমি বিক্রি করে চলতে হতে পারে বলে মনে করে ১৭ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার। অবস্থা সামাল দিতে ভবিষ্যতে ঘরের শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করতে হতে পারে বলে ১৯ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আসায় ২৪ শতাংশ পরিবার মনে করে ব্যয় কমাতে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করতে হতে পারে। মেয়ে-সন্তানকে দ্রুত বিয়ে দেয়ার কথাও বলছেন অনেকে। ২৫ শতাংশ পরিবার মনে করে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের হাতে এখন আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। তারা এখন নিরুপায়।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সানেম মনে করে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিতে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। দেশে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি খাদ্য আমদানিতে আরও বেশি কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। বাজার তদারকিতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি প্রয়োজনে ব্যবসায়ী সংগঠনদের সঙ্গে নিয়ে বাজার তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে তারা। এ ছাড়া বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে বলে জানায় সানেম।

জরিপের ফলাফল তুলে ধরে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্ন আয়ের মানুষ কেমন আছে, তার জন্য জরিপ না করেও বলে দেয়া সম্ভব, তারা কেমন আছে। এ জন্য এই জরিপে যা উঠে এসেছে, তা হয়তো অনেকের জানা। তবে নীতিনির্ধারকদের কাছে বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য পেশাগত দায়িত্বের মধ্য দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষ যে চাপে আছে, সেই বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা।’

তিনি বলেন, ‘এই জরিপে দেশের সব নিম্ন আয়ের মানুষের চিত্র পুরোপুরি উঠে এসেছে কিংবা দরিদ্র জনগোষ্ঠী বেড়েছে, এমনটা বলা না গেলেও সামগ্রিক অবস্থার একটা ধারণা অন্তত পাওয়া সম্ভব। সানেমের আরও গবেষণা আছে, যেখানে দেখা গেছে সরকারি মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান যা বলে, নিম্ন আয়ের মানুষ তার চেয়ে বেশি চাপ অনুভব করে। সুতরাং বর্তমান বাজারের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরতে আমরা জরিপটি করেছি।’

জরিপের বিষয়ে সানেমের গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘ঋণ নেয়াকে অনেকে উদ্ধার পাওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে নিয়েছেন। তবে এসব ঋণে সুদের হার অনেক বেশি। ফলে সুদের দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়তে পারে এসব মানুষ। বিষয়টি এসব মানুষকে ভবিষ্যতে আরও ভোগাবে। আমাদের দেশে বিমা সুবিধা কম, বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বিষয়ে এসব মানুষ বিনিয়োগ কম করবে। সার্বিকভাবে এসব বিষয় এসডিজির লক্ষ্য অর্জন থেকে পিছিয়ে দেবে। বিষয়টি নিয়ে এখনই নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে উদ্যোগ নিতে হবে।’

Download করুন আমাদের App এবং Subscribe করুন আমাদের YouTube Channel: