সংঘাতের ঘটনায় ৩০৩ জনের চোখে অস্ত্রোপচার
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতাল
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: কোটা বিরোধী আন্দোলনে সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনায় চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ৩২৫ জন রোগী এসেছিলেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। এ ছাড়া আঘাত না পেলেও চোখে জটিলতা নিয়ে এসেছিলেন দেড় শতাধিক। তারা সংঘাতের সময় নানাভাবে আহত হয়েছিলেন। এর মধ্যে গত বুধবার পর্যন্ত ৩০৩ জনের চোখেই করতে হয়েছে অস্ত্রোপচার। কয়েকজনের চোখে একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখনো ১৩ জন ভর্তি থেকে নিচ্ছেন চিকিৎসা। তাদের চোখের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের অধিকাংশের চোখে ছররা গুলির আঘাত লাগে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কোটা বিরোধী আন্দোলনের জেরে আহত হয়ে ১৮ই জুলাই আসেন ১৫১ জন। পরদিন আসেন ১০৩ ও ২০শে জুলাই আসেন ৭১ জন। যাদের প্রায় সকলেই অন্য হাসপাতাল থেকে রেফার করা রোগী। ১৮ই জুলাই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ১৪৩ জনকে।
এরপর ১৯শে জুলাই ৬৩ জন, পরবর্তী দিনগুলোতে যথাক্রমে ৫৮, ৪০, ১০, ৫ ও ৬ জনকে ভর্তি করানো হয়। অস্ত্রোপচার করা হয় ৩০৩ জনের। ১৮ই জুলাই অস্ত্রোপচার করা হয় ৬৬ জনের। এরপর পরবর্তী দিনগুলোতে যথাক্রমে ৯৩, ৬৮, ২৫, ২২, ১৮ ও ১১ জনের অস্ত্রোপচার করা হয়। গত বুধবার পর্যন্ত ৩১২ জনকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করা হয়। হাসপাতালের আবাসিক সার্জনের দপ্তর থেকে এই তথ্য জানানো হয়।
বর্তমান হাসপাতালটিতে ভর্তি আছেন ১৩ জন। গতকাল সরজমিন দেখা যায়, নীরব হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। রোগীর সংখ্যা খুবই কম। সংঘর্ষ-সংঘাতের কারণে অন্যান্য রোগীরা কম আসছেন।
রাজধানীর বেসরকারি একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশনের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, আমরা বন্ধুরা মিলে বছিলা এলাকায় মিছিল করছিলাম। এরপর গুলি এসে লাগে। এরপর প্রায় অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পরে থাকি। কয়েকজন লোক এসে আমাকে লাঠি দিয়ে পা থেকে কোমড় পর্যন্ত কয়েকবার পেটায়। চোখে ঝাপসা দেখতে দেখতে আর কিছু বলতে পারি না। একদিন পর শনিবার জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি ঢাকা মেডিকেলে। গত বুধবার তার চোখে অস্ত্রোপচার হয়। এখন চোখে ব্যান্ডেজ অবস্থায় রয়েছেন। চোখে কালো চশমা।
সঙ্গে থাকা তার বাবা বলেন, আমার একটাই ছেলে। এই অবস্থায় আছি আর আল্লাহ আল্লাহ করতেছি। চোখের দৃষ্টি ফিরে আসবে কিনা এই শঙ্কার কথা বলতেই কেঁদে ফেলেন তিনি। তিনি বলেন, আমার ছেলেটার পায়েও অনেক ব্যথা।
রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাশেদ খান রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সংঘর্ষে ছররা গুলিতে আহত হন। তার মামাতো ভাই জানান, প্রথমে তাকে নেয়া হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করেন। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে আনা হয় প্রথমে ফার্মগেটের ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। এরপর আনা হয় আগারগাঁওয়ে। সেখানে পর্যবেক্ষণের পর ডান চোখে করানো হয় অস্ত্রোপচার।
তিনি বলেন, তার ডান চোখের একটু উপরে ছররা গুলির আঘাত দেখা যায়। চোখে চশমা ছিল, আহত থাকা অবস্থায় ডান চোখের গøাস ছিল না। আর চশমার বাম চোখের অংশ ভাঙা ছিল। মোহাম্মদপুরের একটি ছাত্রাবাসে থাকতো। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে নেবার পর আমাকে ওর নাম্বার থেকে ফোন আসে। এরপর আমরা ছুটে যাই।
চোখে আলো ফিরবে কি ফিরবে না এই শঙ্কা নিয়ে সময় পার করছেন মো. রাকিবুল। বরিশাল থেকে আনা হয়েছে তাকে। তার ভাই বলেন, চোখে রক্তক্ষরণ হয়েছে অনেক। অস্ত্রোপচার করার পরও রক্তক্ষরণ থামছে না। ফের অস্ত্রোপচার করা হবে তার। আরেক রোগীর সঙ্গে থাকা স্বজন রোগীর বিষয়ে বলেন, ডাক্তার বলেছেন ওর চোখে কিছু একটা তীক্ষè আঘাত লেগেছে। ওই রোগীকে ধানমÐি ২৭ নম্বর থেকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। সেখানে ব্যান্ডেজ করানোর পর বাম চোখ থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। ডাক্তারের পরামর্শ মতো এখানে আনা হয়। সেখানে জরুরি অপারেশন করা হয়।
মিরপুর স্টেডিয়ামের বিপরীতে ভ্রাম্যমাণ ফাস্টফুডের দোকান চালান আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, গত শনিবার দোকানের মালামাল বাড়িতে আনার জন্য গিয়েছিলাম। ফিরে আসার পথে মিরপুর ১০ নম্বরের একটি গলি দিয়ে যাবার সময় সংঘর্ষ বাধে, গোলাগুলি শুরু হয়। দ্রæত চলে আসার সময় চোখে কী যেন একটা এসে লাগে। এরপর দৌড়ে পালিয়ে আসি। একটি দোকানে যাই ওষুধ আনার জন্য। তখন চোখ লাল হয়েছিল। দোকানদার বলে, দ্রæত চোখের হাসপাতালে যেতে। কিন্তু আমি এরপরও যাই নাই। রাতেও যখন চোখের লাল কমেনি এরপর একজন ডাক্তারের কাছে যাই। তিনিও ওষুধ দিয়ে হাসপাতালে আসতে বলেন। রাত হওয়ায় সেদিন আসি নাই। পরের দিন এখানে আসি।
হাসপাতালের একজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, এখন বাইরের রোগী খুবই কম আসছে। আন্দোলনে আহত রোগীরাই বেশি আসছে। একজন নার্স বলেন, এখানে চোখের অস্ত্রোপচার শেষে হাসপাতালে বেশি রাখার প্রয়োজন হয় না। তাদের অধিকাংশকেই বাড়িতে পাঠানো হয়। এরপর ফলোআপে যখন আসবেন তখন জানা যাবে চোখের অবস্থা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক গোলাম মোস্তফা বলেন, এখানে আসা রোগীদের অধিকাংশই ছররা গুলিতে আহত। তাদের অধিকাংশই চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন। তারা যখন ফলোআপে আসবেন তখন পরিস্থিতি বোঝা যাবে।