শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছে চীন, বিশেষজ্ঞদের চোখ এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে
নিক্কেই এশিয়ার রিপোর্ট
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: রোববার বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ সহজ জয় পেয়েছে। যদিও প্রধান বিরোধী দলের বয়কটের কারণে আগে থেকেই বিষয়টি ধারণা করা হচ্ছিল। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে ঢাকার ক্রমবর্ধমান টানাটানির সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের পর কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিল। তবে চীন ও রাশিয়া দ্রুতই শেখ হাসিনার জয়কে স্বাগত জানিয়েছে।
টানা চতুর্থ বারের মতো ক্ষমতায় বসেছেন শেখ হাসিনা, যাকে সন্দেহজনক বলছেন অনেকেই। তার এই জয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিকে অজানা গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান বলেছেন, ঐতিহাসিকভাবে নির্বাচনগুলি সাধারণত বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সমাধান করতো, তা সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হোক কিংবা একতরফা হোক। তবে এবার নির্বাচন অনিশ্চয়তা আরও বাড়াতে পারে।
কেউ কেউ নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রথমবারের মতো কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরঞ্চ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সম্মিলিতভাবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। ফলে সংসদে বিরোধী দল কে গঠন করবে তা নিয়ে একটি ধাঁধা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে যেতা এই স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বীদের সবাইকেই আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। যদিও নির্বাচনকে বৈধ প্রমাণ করতে তাদেরকে আওয়ামীলীগের মনোনিত প্রতিযোগিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বলা হয়।
এ কারণে আওয়ামীলীগের মধ্যেই ফাটল সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শেখ হাসিনার জন্য এর থেকেও বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে আন্তর্জাতিক চাপ। প্রায়শই ‘আয়রন লেডি’ হিসাবে আখ্যা দেয়া হয় ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনাকে। মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং পশ্চিমা দেশগুলি বারবার অভিযোগ করেছে যে, তিনি বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি এবং অন্যান্য সমালোচকদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ক্র্যাকডাউন চালিয়েছেন এবং আইনি জটিলতার মাধ্যমে তাদের দমন করেছেন।
শেখ হাসিনা রোববার জোর দিয়ে বলেন, দেশে গণতন্ত্র যেন অব্যাহত থাকে সে জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সোমবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন যে, তিনি এখন অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করতে চান। বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নির্বাচন বয়কট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে। নির্বাচনে একটি দল না থাকা মানেই গণতন্ত্র অনুপস্থিত নয়।
তবে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল যে, তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার সঙ্গে জড়িতদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করছে। দেশটি এর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশের একটি আধাসামরিক বাহিনীর উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। নির্বাচনের দিনও বেশ কিছু সহিংসতা এবং উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে ওয়াশিংটনকে তার দৃষ্টিভঙ্গি নরম করতে রাজি করানো অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ জ্যোতি রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা তা নিয়ে বিশেষ অনিশ্চয়তা রয়েছে। বাংলাদেশের বহু বিলিয়ন ডলারের পোশাক শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্লায়েন্ট যুক্তরাষ্ট্র। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশের বাণিজ্যকে টার্গেট করে শাস্তি দিতে পারে দেশটি। জ্যোতি রহমান বলেন, গার্মেন্টস সেক্টরকে লক্ষ্য করে বা প্রধান ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলে তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা বাড়াতে পারে। দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এরইমধ্যে চাপে রয়েছে অর্থনীতি। এদিকে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে হিংসাত্মক বিক্ষোভের ফলে গার্মেন্টস সেক্টর সম্প্রতি উত্তেজনাকর কয়েকটি সপ্তাহের মধ্য দিয়ে গেছে, যার ফলে একাধিক শ্রমিকের মৃত্যু এবং কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
ওই সঙ্কট নিরসন ও কারখানাগুলি পুনরায় চালু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশী সরবরাহকারীদের জন্য ‘লেটার অব ক্রেডিটে’ একটি ধারা যুক্ত করেন এক মার্কিন ক্রেতা, যার কারণে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে বলা হয়, মার্কিন সরকার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ক্রেতা চালানের জন্য অর্থ প্রদানের জন্য বাধ্য থাকবে না।
উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, পশ্চিম থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে আঘাত হানবে তা নিয়ে বাড়িয়ে বলার কিছু নেই। যদিও এখন পর্যন্ত এ জাতীয় উদ্বেগগুলি শুধুমাত্র ‘অনুমানমূলক’। তবে নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশে যদি তাৎক্ষণিকভাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয় পতন ঘটে, এর জন্য দায়ী হবে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা। সম্ভাব্য অস্থিরতার কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হতে পারে। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বাণিজ্য, এমনকি মৌলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক নিয়াজ আসাদুল্লাহ আরও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছেন, যা দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে নতুন সরকারের ওপর জনগণের সমর্থনের অভাব রয়েছে। আরও দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সরকারের নীতির ওপরে মানুষের আস্থা হ্রাস পাবে। এর ফলে আইএমএফের মতো বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলির থেকে আরও ঋণ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের পথে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
গত বছরের শেষের দিকে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পেতে প্রথম পর্যালোচনা পাড় করেছে বাংলাদেশ। কোভিড মহামারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমাদের থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা একটি ভয়ানক ধাক্কা হতে পারে বলে মনে করেন আসাদুল্লাহ।
কিছু বিশ্লেষক এটাও বিশ্বাস করেন যে, সন্দেহজনক নির্বাচনের কারণে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়িক সহযোগিতা হারাতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বাংলাদেশি আর্থিক বিশ্লেষক শাফকাত রাব্বে বলেন, বাংলাদেশ অতীতে একটি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র ছিল। কিন্তু এই সর্বশেষ একতরফা নির্বাচনের কারণে বিশ্ব এখন বাংলাদেশকে রাশিয়া, চীন বা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শ্রেণীবদ্ধ করবেন। তিনি আরও বলেন, এ কারণে অবশ্যই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরও বিস্তৃত হবে এবং ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য অংশীদারিত্বকে বাধাগ্রস্ত করবে। যদিও তিনি মনে করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে গোটা অর্থনীতির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা কম। কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু অলিগার্ক, নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং ক্লেপ্টোক্র্যাটদের টার্গেট করে নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই চাপ অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশকে ভারত ও জাপানের মতো গণতন্ত্রের জন্য একটি কৌশলগত ‘শক্তি’ হিসাবে দেখা হয়। এই দেশগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব মোকাবেলা করতে চায়। রাশিয়ার পাশাপাশি চীনের দিকেও ঝুঁকে পড়তে পারে ঢাকা। সোমবার প্রথম বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে যারা শেখ হাসিনার বাসভবনে যান তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। তিনি নির্বাচনে জয়ের জন্য তাকে অভিনন্দন জানান। স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে যে, তিনি বলেছেন- চীন সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করতে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে।
এর আগে রাশিয়ার নির্বাচন কমিশনের সদস্য আন্দ্রে শুটভ, যিনি বাংলাদেশে দেশটির পর্যবেক্ষক মিশনের প্রধান ছিলেন, তিনি মিডিয়াকে বলেন যে এই নির্বাচন ‘বৈধ’ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির নিক্কেইকে বলেছেন যে, শেখ হাসিনা চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ থেকে সমর্থন জোগাড় করে খুব দক্ষতার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র চাপ মোকাবেলা করেছেন। এই দেশগুলো শুরু থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের জন্য ওয়াশিংটনের সমালোচনা করে আসছিল। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, এই কৌশল বেশ ভালো ভাবেই কাজ করছে। এছাড়া শেখ হাসিনার সবসময় ভারতের ব্যাকআপ ছিল। দেশটি শেখ হাসিনাকেই বাংলাদেশের জন্য সেরা অপশন হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা এখনও অনিশ্চিত। সরকারের কাছে এখন ‘ওয়েট এন্ড সি’ গেম খেলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।