রায়হান হত্যার তিন বছর ৫৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ, এসআই আকবরের আবেদন খারিজ
প্রথম নিউজ, সিলেট : ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর মধ্যরাতে সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় আখালিয়ার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে। নির্যাতনে রায়হান যখন নিস্তেজ হয়ে পড়েন তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর পুলিশ রায়হানের মৃত্যু গণপিটুনিতে হয়েছে বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আজ ১০ অক্টোবর রায়হান হত্যার তিন বছর পূর্ণ হলো। ইতোমধ্যে আলোচিত এই হত্যা মামলায় ৬৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক। এ ছাড়া আদালতে ১৬৪ ধরায় জবানবন্দি দেওয়া ১০ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এদিকে, ঘটনার পর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পালিয়ে যাওয়া কোম্পানীগঞ্জের বাসিন্দা আবদুল্লাহ আল নোমানের মালামাল ক্রোকের আদেশ তামিল করেছে পুলিশ। তিনি রায়হান হত্যার ৬ নম্বর আসামি। নোমান ছাড়া ওই মামলার বাকি পাঁচ আসামি সিলেট মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। পাঁচ জনের মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন চার জন।
মামলার প্রধান অভিযুক্ত সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া তার আইনজীবীর মাধ্যমে গত ১০ সেপ্টেম্বর ব্যক্তিগত অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আদালতে হাজিরা থেকে অব্যাহতির পিটিশন দাখিল করলেও আদালত তা আমলে নেননি।
আদালত সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে আলোচিত এই হত্যা মামলাটির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করবেন আদালত। মামলায় অভিযুক্ত এসআই হাসান উদ্দিন উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামিনে রয়েছেন।
মামলার ৬৯ জন সাক্ষীর মধ্যে রায়হানের মা সালমা বেগম, স্ত্রী তাহমিনা আক্তার সাক্ষ্য দিয়েছেন। গত ৭ সেপ্টেম্বর মামলায় সর্বশেষ সাক্ষ্য দিয়েছেন সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় আদালতের বিচারক শারমিন খানম নিলা। আগামী ১২ অক্টোবর সাক্ষ্য দেওয়ার কথা রয়েছে সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক সাইফুর রহমানের। এ ছাড়া পরবর্তী সময়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেন, মুহিদুল ইসলাম ও সিলেট কোতয়ালি থানার সাবেক উপপরিদর্শক আবদুল বাতেন এবং সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকের সাক্ষ্য দেওয়ার কথা রয়েছে।
রায়হান হত্যা মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবুল ফজল চৌধুরী বলেন, ‘ইতোমধ্যে আদালতে নিহত রায়হানের স্ত্রী, মা, সুরতহাল প্রস্তুতকারী ও চাচাসহ ৫৬ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমরা আশাবাদী বর্বর ও ন্যক্কারজনক এ ঘটনার যথাযথ বিচার পাবো। ইতোমধ্যে আদালতে যতজন সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা সবাই ঘটনার যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন।’
নিহত রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম বলেন, ‘মামলার আসামিরা সাক্ষ্য গ্রহণের আগে মামলা আপস করতে ৫০ লাখ টাকার প্রলোভন দেখিয়েছে। তবে আমরা তাতে পা দিইনি। আশা করছি, আমরা ন্যায়বিচার পাবো। সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।’
আদালত সূত্র জানায়, নিহত রায়হানের দেহে ১১১ আঘাতের চিহ্ন উঠে আসে ফরেনসিক রিপোর্টে। আঘাতগুলো লাঠি দ্বারাই করা হয়েছে। আর অতিরিক্ত আঘাতের কারণে দেহের ভেতর রগ ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণে রায়হানের মৃত্যু হয়। আঘাতে দেহের মাংস থেতলে যায়। রগ ফেটে গিয়ে দেহের মধ্যে রক্তক্ষরণ হয়। আর অতিরিক্ত আঘাতে মূর্ছা যান রায়হান। আঘাত করার সময় রায়হানের পাকস্থলী খালি ছিল।
রায়হান হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়। অন্য অভিযুক্তরা হলেন– সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, টিটু চন্দ্র দাস (৩৮), ফাঁড়ির ‘টুইআইসি’ (সেকেন্ড-ইন-কমান্ড) পদে থাকা সাময়িক বরখাস্ত উপপরিদর্শক হাসান উদ্দিন ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার আবদুল্লাহ আল নোমান (পলাতক)।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর মধ্যরাতে সিলেটের আখালিয়ার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরদিন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। রায়হানের মৃত্যুর পরদিন ১২ অক্টোবর তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে কোতয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পর মহানগর পুলিশের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে ফাঁড়িতে নিয়ে রায়হানকে নির্যাতনের সত্যতা পায়। ফাঁড়ির ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার জনকে ওই বছরের ১২ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত এবং তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর কনস্টেবল হারুনসহ তিন জনকে গ্রেফতার করে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই।
তবে প্রধান অভিযুক্ত আকবর ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান। ৯ নভেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তের শেষ পর্যায়ে ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রধান আসামি আকবরকে পালাতে সহায়তা করা ও আলামত গোপন করার চেষ্টার অভিযোগে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ‘টুআইসি’ (সেকেন্ড-ইন-কমান্ড) পদে থাকা সাময়িক বরখাস্ত উপপরিদর্শক হাসান উদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এরপর ২০২১ সালের ৫ মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আলোচিত এ মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেয়। নির্ধারিত তারিখে শুনানি শেষে আদালত ৩০ সেপ্টেম্বর এক হাজার ৯০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন (অভিযোগপত্র) গ্রহণ করেন।