রপ্তানি সম্ভাবনার ব্রাজিলের বাজারে টানা পার্টির হাত
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একটি পোশাক কারখানা থেকে সোয়েটার ভর্তি কার্টন পাঠানো হয়। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান ক্রেতা পেয়েছে খালি কার্টন।
প্রথম নিউজ, অনলাইন: বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সম্ভাবনার রপ্তানির ও ফুটবল বিশ্বের পরাশক্তি ব্রাজিলের বাজারে টানা পার্টির হাত পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একটি পোশাক কারখানা থেকে সোয়েটার ভর্তি কার্টন পাঠানো হয়। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান ক্রেতা পেয়েছে খালি কার্টন। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে রপ্তানিকারকরা। তাদের আশঙ্কা, তৃতীয় কোনো পক্ষ জালিয়াতি করে পণ্য সরিয়ে নিয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত শুরু করছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। সূত্রমতে, বাংলাদেশ থেকে সোয়েটার অর্ডার করে ব্রাজিলিয়ান ব্র্যান্ড মারিসা। এই ব্র্যান্ডটিই সম্প্রতি খালি কার্টন হাতে পেয়েছে। অথচ প্রতিটি কার্টন সোয়েটারে পূর্ণ থাকার কথা। অর্থাৎ প্রতিটি কার্টনে ১০টি করে সোয়েটার থাকার কথা। কিন্তু কার্টনগুলো ছিল ফাঁকা।
আবার কিছু কার্টনে মিলেছে তিনটি করে সোয়েটার। এমনই অভিজ্ঞতা আর প্রতারণার শিকার ব্রাজিলের ফ্যাশন ব্র্যান্ড মারিসার উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ থেকে সোয়েটার অর্ডার করে এমন অভিজ্ঞতা কোম্পানিটির। ইতিমধ্যেই হতাশ হয়ে খালি কার্টনের ভিডিও রপ্তানিকারককে পাঠিয়েছে সেই ক্রেতা।
সূত্র জানান, গত নভেম্বরে বাংলাদেশ থেকে চালানটি যায় ব্রাজিলে। মারিসার প্রায় সোয়া লাখ ডলারের সোয়েটারের অর্ডারটি নেয় সাভারের প্রতিষ্ঠান ট্রেন্ড এন স্টাইল লিমিটেড। গাজীপুরের এ প্লাস সোয়েটার কারখানায় পণ্যগুলো তৈরি করে কোম্পানিটি। এরপর সেখান থেকে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে পৌঁছে যায় ব্রাজিলে। কারখানা থেকে কনটেইনার, কনটেইনার থেকে ডিপো, ডিপো থেকে জাহাজ প্রতিটি স্তরে রপ্তানি পণ্য নানাভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়। ফলে খালি কনটেইনার জাহাজে ওঠার সুযোগ নেই। আবার গন্তব্য দেশেও নানা প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে পণ্য পৌঁছায় স্টোরে। রপ্তানিকারকদের পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে সিএন্ডএফ, ফ্রেইট ফরওয়ার্ড ও শিপিং এজেন্ট। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা সংঘবদ্ধভাবে এ জালিয়াতি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র কাছে অভিযোগ করেছেন উদ্যোক্তারা। নেতারা বলছেন, এমন জালিয়াতির ফলে শুধু কারখানা নয়, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই ক্রয়াদেশের এখনো অনেক চালান ব্রাজিলের পথে রয়েছে। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, সেগুলোতেও খালি কার্টন মিললে ক্ষতি অনেক বেশি হবে।
বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি শহীদুল আজিম বলেন, আমাদের ধারণা এই ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের ডিপোতে। কেননা ডিপোতেই পণ্য সঠিকভাবে বুঝিয়ে নেয়া হয়। যদি পণ্য কোনো কন্টেইনারে কম থাকতো সেটা এখানেই ধরা পড়তো। কিন্তু বিষয়টা ধরা পড়েছে পণ্য পৌঁছানোর পর। কারণ পণ্য বুঝিয়ে দেয়ার পর আর কোনো কারখানা মালিকের দায়িত্ব থাকে না। ফলে বিষয়টি এখন আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, এতে ক্রেতা হারানো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। এখানে সংঘবদ্ধভাবে এ জালিয়াতি করা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ব্রাজিলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানির বৃহৎ আমদানিকারক দেশগুলোতে উৎসাহব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অপ্রচলিত বাজারগুলোতেও রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ও বিজিএমইএ’র তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে অনিয়মিত গন্তব্য বা অপ্রচলিত বা নতুন বাজারে রপ্তানি ২.৪৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩.১৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে জাপানে রপ্তানি ৫৯৭.৮৩ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে বছরওয়ারি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮.১১ শতাংশ। এরমধ্যে শুধু ব্রাজিলের বাজারেই ৪৪.৫৩ শতাংশ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। বাণিজ্য তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আর্জেন্টিনার চেয়ে ব্রাজিলে ১০ গুণ বেশি পণ্য রপ্তানি করে থাকে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে এমন ২০টি দেশের মধ্যে ব্রাজিলের অবস্থান অষ্টম।
ব্রাজিলে রপ্তানির চেয়ে আমদানি ২০ গুণ: ব্রাজিল থেকে গত অর্থবছর বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ২২৫ কোটি ডলার। এর বিপরীতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১১ কোটি ডলার। এর অর্থ ব্রাজিল বাংলাদেশ থেকে যা আমদানি করে, তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি রপ্তানি করে এ দেশে। আর্জেন্টিনার মতো বড় ব্যবধান না হলেও বাংলাদেশ-ব্রাজিল আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যও একতরফা ব্রাজিলের অনুকূলে।
ব্রাজিল থেকে সাধারণত চিনি, তেলবীজ, খাদ্যশস্য, বিভিন্ন ধরনের ফল, আয়রন ও স্টিল আমদানি করে বাংলাদেশ। অন্য দেশের মতো ব্রাজিলেও তৈরি পোশাকই বেশি রপ্তানি হয়ে থাকে বাংলাদেশ থেকে। গত অর্থবছরে দেশটিতে পোশাক খাতে নিটের রপ্তানি ছিল প্রায় সাড়ে ৫ কোটি ডলার, আর ওভেনের ৪ কোটির মতো। অর্থাৎ ব্রাজিলে শুধু পোশাক রপ্তানি হয়েছে সাড়ে ৯ কোটি ডলার, যা আর্জেন্টিনায় মোট রপ্তানির ১০ গুণ। ব্রাজিলে রপ্তানি হওয়া অন্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে পিপিই, ওষুধ, চামড়াপণ্য, পাদুকা, ফার্নিচার, খেলনা ইত্যাদি।
বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, প্রধান গন্তব্য দেশগুলোর পাশাপাশি অপ্রচলিত বাজারেও রপ্তানি সম্প্রসারণে নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। সবকিছু মিলিয়ে আমরা রপ্তানি বাড়াতে সক্ষম হয়েছি।
ব্রাজিলে সোয়েটার রপ্তানি করে ডিজাইন টেক্স নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে ব্রাজিল বেশ সম্ভাবনাময়। প্রচলিত বাজারের ওপর অতিনির্ভরতা কমাতে ব্রাজিলের মতো বাজারে এখন মনোযোগ দিচ্ছেন তারা। তবে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটছে তাতে ভীতির সৃষ্টি করছে। এ রকম ঘটনা ঘটলে ভবিষ্যতে বাজার হারানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।