যুদ্ধবিরতি শেষ: গাজায় আবার বোমা, আর্তনাদ
প্রথম নিউজ, অনলাইন ডেস্ক: গাজায় আবার আতঙ্ক। আবার লাশ। আবার মুহুর্মুহু বোমা হামলা। অকাতরে মারা হচ্ছে মানুষ। একে অপরকে দোষারোপের মধ্য দিয়ে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি স্থানীয় সময় শুক্রবার সাড়ে ৭টায় শেষ হয়। এরপরই গাজার দক্ষিণাঞ্চলে রাফা সীমান্ত, খান ইউনুসসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর এই হামলায় এরই মধ্যে কমপক্ষে ১৭৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গাজাবাসীর জন্য অতি প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা রাফা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
শুক্রবার সকালে গাজার উত্তরাঞ্চলে অনুপ্রবেশ করা ইসরাইলি সেনাদের ভারি গুলির শব্দ শোনা গেছে। সেখানে ইসরাইলি সেনাদের মোকাবিলা করছে গাজার যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস। এই যুদ্ধে ইসরাইল মোতায়েন করেছে যুদ্ধবিমানসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম।
বিমান হামলায় টার্গেট করা হচ্ছে গাজার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, দক্ষিণে খান ইউনুস। এর আগে যুদ্ধ শুরুর পর পরই গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে লোকজনকে দক্ষিণে সরে যেতে বলা হয়। এক পর্যায়ে আল শিফা হাসপাতালে আশ্রয় নেয়া মানুষকেও সেখান থেকে বের করে দেয় ইসরাইলিরা। এর মধ্য দিয়ে পুরো উত্তরাঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ঘোষণা দেয় ইহুদি রাষ্ট্রটি। উত্তরাঞ্চল থেকে পালিয়ে গিয়ে গাজাবাসী আশ্রয় নিয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলে। এখন সেখানেও তাদের রেহাই নেই। বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। আল নাসের হাসপাতালের খুবই কাছে একটি বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরাইলিরা।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেল সতর্কতা দিয়ে বলেছেন, বিশ্বে শিশুদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান হলো গাজা। যদি নতুন করে এই যুদ্ধ সহিংস পর্যায়ে যায় তাহলে শত শত শিশু প্রতিদিন মারা যাবে। হামাসের হাতে জিম্মি থাকা কমপক্ষে ৩০টি শিশুকে নিরাপদে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তারা পরিবারের কাছে ফিরে গেছে। এ অবস্থায় শিশুরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের আইন মেনে চলতে উভয় পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান ক্যাথেরিন রাসেল।
বর্তমানে পরিবার নিয়ে খান ইউনুস শহরে অবস্থান করছেন মোহাম্মদ গালাইয়িনি নামে একজন বৃটিশ নাগরিক। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৬ টায় ড্রোন উড়া শুরু হয়। সাড়ে ৭টার দিকে বোমা হামলা শুরু হয়। প্রতি ১০,১৫, ২০ মিনিটে বিরতিহীনভাবে বোমা হামলা হচ্ছে। ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) লিফলেট ফেলছে। তাতে সতর্কতা দিয়ে বলা হয়েছে, খান ইউনুসের পূর্বাংশ এবং সালাহ আল দিন এলাকা বিপজ্জনক রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। লোকজনকে মিশর সীমান্তের কাছে রাফা এলাকায় সরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ওদিকে ইসরাইলের দিকে রকেট নিক্ষেপ করেছে হামাস ও অন্য গ্রুপগুলো। কিন্তু এসব রকেটকে বিকল করে দেয়ার জন্য ইসরাইলে রয়েছে আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ফলে হামাসের নতুন এই রকেট হামলায় ইসরাইলে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক এজেন্সি ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার বলেছেন, নতুন করে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ গাজার মানুষের জন্য বিপর্যয়কর। তিনি বলেন, নাসের হাসপাতালে রোগীতে ভর্তি। কোনো ফাঁকা স্থান নেই। বিশেষ করে সেখানে আগের হামলায় আহত শিশু ও লোকজন চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফলে ওই হাসপাতালে আর কোনো স্থান সংকুলান হচ্ছে না। বর্তমানে গাজায় কার্যক্রম সচল থাকা সবচেয়ে বড় হাসপাতাল এটি। সেখানে বহু পরিবার মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে ঘুমাচ্ছেন। এ অবস্থায় ইসরাইলের হামলায় অগ্নিদগ্ধ বা আহত আর শিশুকে চিকিৎসা দেয়া অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘের অন্যান্য এজেন্সি বলেছে, গাজায় সচল থাকা অন্য হাসপাতালগুলোর একই অবস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি বিষয়ক সিনিয়র কর্মকর্তা রোব হোল্ডেন বলেছেন, গাজা সিটির আল আহলি হাসপাতাল যেন হরর ছবি। তার ওপর আবারও বোমা হামলা শুরু হয়েছে। এ সপ্তাহের শুরুর দিকে তার টিম পরিদর্শন করেছে এই হাসপাতাল। তারা রিপোর্টে বলেছেন, ভয়াবহ ক্ষতযুক্ত রোগীরা মেঝেতে শুয়ে আছেন। সেই মেঝে ভেসে যাচ্ছে তাদের রক্তে। বাইরে কার পার্কে লাইন দিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে মৃতদেহ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে গাজার মোট ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে সামান্য বা আংশিক কার্যকর আছে ১৮টি। ফিলিস্তিন বিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি রিচার্ড পিপারকর্ন বলেন, চলমান এই যুদ্ধে ভেঙে পড়ছে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সহিংসতা আবার শুরু হওয়ায় আমরা চরমমাত্রায় উদ্বিগ্ন। এর ফলে সেখানে আরও মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে। রান্নার গ্যাস, খাদ্য ও পানির সরবরাহ ভয়ঙ্কর মাত্রায় নিম্ন পর্যায়ে। দোকানপাট ফাঁকা। কিছুই নেই তাতে। এমন অবস্থায় বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য বিতরণ করার জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই। বহু মানুষ তাঁবুতে ঘুমাচ্ছেন। তারা বিবিসিকে বলেছেন, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তাদের অবস্থা শোচনীয়। গরম কাপড় সহ আরও ত্রাণ পাঠানোর আবেদন জানিয়েছে এসব মানুষ।
ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের ত্রাণ বিষয়ক এজেন্সির প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, জ্বালানি সহ এদিন গাজায় কোনোই মানবিক ত্রাণ অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। সাত দিনের যুদ্ধবিরতির সময় কয়েক শত ট্রাক ত্রাণ নিয়ে প্রবেশ করেছে গাজায়। যুদ্ধ শুরুর আগে প্রতিদিন গাজায় প্রবেশ করতো প্রায় ৫০০ ত্রাণবাহী ট্রাক। ফলে যুদ্ধবিরতির পর যে সামান্য কয়েকশত ট্রাক প্রবেশ করেছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সিনিয়র উপদেষ্টা মার্ক রেগেভ শুক্রবার বলেছেন, হামাস যদি আরও জিম্মিকে মুক্তি দিতো তাহলে এই যুদ্ধবিরতি আরও বর্ধিত হতে পারতো। তারা ২০ জন নারীকে বিদ্যমান চুক্তির অধীনে মুক্তি দিতে পারতো। কিন্ত তারা তা দেয়নি। এসব নারী কি সাধারণ মানুষ নাকি সেনা সদস্য এমন প্রশ্নের জবাবে রেগেভ বলেন, এর মধ্যে কিছু নারীর বয়স ২০এর কোটায়। তারা সামরিক বাহিনীর সার্ভিস শেষ করেছে।
অন্যদিকে আরও জিম্মি মুক্তি দেয়ার জন্য হামাস বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছে বলে দাবি করেছে। এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইল। আইডিএফ বলেছে, শুক্রবার হামাসের একটি কমান্ড সেন্টার, ভূগর্ভস্থ স্থাপনা এবং একদল যোদ্ধার ওপর হামলা চালিয়েছে তারা। গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।