জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরিতে ঐকমত্য

জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরিতে ঐকমত্য

প্রথম নিউজ, অনলাইন:  জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এতে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সব দলের অবদান অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সর্বসম্মতিক্রমে এই ঘোষণাপত্র তৈরিতে তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না বলে মত এসেছে।

ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের বৈঠকে এই ঐকমত্য হয়েছে বলে সব দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এই বৈঠক হয়। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শুরু হয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা এই বৈঠক চলে।

জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরিতে ঐকমত্যতবে সরকার গঠনের সাড়ে পাঁচ মাস পর এই ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সব দল এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন দরকার বলে মনে করছে।

সভায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলাম, গণতন্ত্র মঞ্চ, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ, এনডিএম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। গতকালের বৈঠকের মাধ্যমে এই ঘোষণাপত্র তৈরি নিয়ে মাসখানেক ধরে যে উত্তেজনা চলছিল তা আপাতত কমল বলে মনে করা হচ্ছে।

বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। সবাই বলেছেন এ ধরনের একটা ঘোষণাপত্র করার প্রয়োজন আছে।
’ তিনি বলেন, মোটাদাগে ঘোষণাপত্রে সবার অবদান বলতে হবে, ধারাবাহিকতা উল্লেখ করতে হবে। ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক ও আইনগত ভিত্তি কী হবে সেটাও স্পষ্ট করতে হবে।

আসিফ নজরুল বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ও ছাত্র-জনতাসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মতিক্রমে এই ঘোষণপত্র প্রণয়ন করতে হবে। এর জন্য যত সময় প্রয়োজন নেওয়া যেতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো এ-ও বলেছে, অযথা কালবিলম্ব যেন না হয়।
সবাই ঐকমত্য হয়েছের, আরো নিবিড় পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এ ধরনের ঘোষণাপত্র হওয়া উচিত। সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, ‘এই প্রক্রিয়ায় আমরা সফল হব। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সবাই একত্রে যেভাবে ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারী শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছি, তেমনি সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এই ঘোষণাপত্র তৈরি করতে পারব।’

সময়সীমা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের যারা অংশ নিয়েছে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছে সর্বসম্মতিক্রমে একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করার জন্য। যত সময় লাগুক তা যেন নেওয়া হয়। তাড়াহুড়া যেন না করা হয়। অযথা কালক্ষেপণ না করা হয়। এই লক্ষ্য অনেকে প্রস্তাব করেছে আলোচনা করে একটি কমিটি গঠন করার জন্য। এই প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। শুধু কী পদ্ধতিতে করা হবে, বিভিন্ন রকম মতামত এসেছে। কোথাও অনৈক্যের সুর নেই। সবাই বলেছেন, ঘোষণায় যেন সবার মালিকানা থাকে।

আরো আলোচনা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলোচনা হতে পারে। কমিটি হতে পারে। সবার মতামত নিয়ে খুব দ্রুত একটা কর্মকৌশল ঠিক করা হবে।

এর আগে গত ৩১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নিলেও বিএনপির আপত্তির কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। এরপর সরকার এই ঘোষণাপত্র দেবে বলে জানানো হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকালের এই বৈঠক হলো।

 

বিএনপি

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রশ্ন করেছি, সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন আছে কি না? যদি থাকে সেটার রাজনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং আইনি গুরুত্ব কী; সেটা নির্ধারণ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে সেখানে যেন কোনো ফাটল সৃষ্টি না হয় সেখানেও আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। যদি কোনো রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয় সে দলিলটাকে আমরা অবশ্যই সম্মান করি। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যেন সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সবার পরামর্শ নেওয়া হয়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি। আমি প্রধান উপদেষ্টা ও সব উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেছি, সে বিষয়ে যেন আপনারা নজর রাখেন এবং সে হিসেবে পদক্ষেপ নেন। যেন জাতীয় ঐক্যে কোনো ধরনের ফাটল সৃষ্টি না হয়। আমাদের মধ্যে যেন কোনো ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয়।’

সালাহউদ্দিন বলেন, ‘রাজনৈতিক দল যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিল তাদের সবাইকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য আমরা দিতে চাই। এখন কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি এবং ফ্যাসিবাদী দোসররা যেকোনো রকমের অনৈক্যের বীজ যেন আমাদের ভেতরে বপন করতে না পারে সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।’

 

জামায়াত

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘মোটা দাগে বলতে পারি, প্রতিটি দল একটা ঘোষণাপত্র হওয়া প্রয়োজন সেটা অনুভব করেছে, তবে তাড়াহুড়া করে নয়। তাড়াহুড়া করলে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এ জন্য সময় নিতে হবে। রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, অভ্যুত্থানের ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীনতার পূর্বাপর ইতিহাসসহ সব কিছু মিলিয়ে একটা সুলিখিত ঘোষণাপত্র কিভাবে তৈরি করা যায় সে আলোচনা হয়েছে। আমরা আলাদাভাবে প্রস্তাব দেব। পরে প্রস্তাবগুলো একত্র করে একটি সুন্দর ঘোষণাপত্রে রূপান্তর করা হবে।’

গোলাম পরওয়ার বলেন, বেশি বিলম্ব হলে ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ পেতে পারে। সেই সুযোগ যাতে কেউ না পায়। তাই দেরি না করে এই উদ্যোগ শুরু করা উচিত। সরকারের একজন উপদেষ্টা দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, উনারা রাজনৈতিক দলের মতামতগুলো পর্যালোচনা করবেন। একটা হোমওয়ার্ক করার পর আবার আলোচনায় বসবেন।

 

নাগরিক কমিটি

সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য বলে জানান জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে কিছু পর্যালোচনাসহ প্রকাশ হবে। এর মধ্যে কিছু দৃষ্টিভঙ্গিগত ও শাব্দিক চয়নে সবার আলোচনার প্রয়োজন। সেটার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার কাছে সময় চেয়েছে। তিনি দলগুলোর সময়ক্ষেপণের বিষয়ে লক্ষ রাখতে বলেছেন, যাতে কালবিলম্ব না হয়, আবার যেন দ্রুতগতিতেও না হয়। মাঝামাঝি সময়ে ঐকমত্যে পৌঁছে সুন্দর একটি জিনিস প্রকাশ করতে পারি সে বিষয়ে সবাই ঐকমত্য হয়েছি।’

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পথে উত্তরণ হতে এই দলিল ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন নাসীরুদ্দীন।

আলটিমেটাম দিয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই একটা পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে রয়েছি। আলটিমেটামের কথা এসেছিল, কিন্তু নির্দিষ্ট করে আলটিমেটাম হয়নি। তবে এটা সম্মত হয়েছি—দেরিও নয়, আবার তাড়াহুড়াও নয়, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রকাশ করা হবে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব আরিফ সোহেল বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজন মিলে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছি। সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করা হবে, এটা এখন নিশ্চিত। পরবর্তী ধাপে আলোচনা হবে ঘোষণাপত্রে কী কী থাকবে।’

এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘ঘোষণাপত্র নিয়ে আমরা একটি লিখিত পরামর্শ দিয়েছি। ঐতিহাসিক দলিল তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। আমাদের প্রক্রিয়ায় একমত হওয়া দরকার। কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গণ-অভ্যুত্থানের ফরমান লিখিত হবে। সব দল তা সম্মতির ভিত্তিতে গ্রহণ করবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মতো।’

তিনি বলেন, ঘোষণাপত্র তৈরিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা অন্য কোনো কমিটি বা কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে দেওয়া হয়েছে।

জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি জুনাইদ আল হাবিব বলেন, ঘোষণাপত্রে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের গণহত্যার বিষয় সংযোজন করতে হবে। পাখির মতো গুলি করে ওলামায়ে কেরামকে হত্যা করা হয়েছে, হাজার হাজার ওলামায়ে কেরামকে গ্রেপ্তার করে বছরের পর বছর জেলখানায় বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে, সেটাও এখানে উল্লেখ থাকতে হবে। 

ঘোষণাপত্র তৈরিতে তাড়াহুড়া ও যেনতেন প্রক্রিয়া যেন না করা হয় বলে জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, এটা যেন তাড়াহুড়া করে, যেনতেন প্রক্রিয়ায় না করা হয়। ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য সরকারের দিক থেকে এই উদ্যোগটা নেওয়া দরকার। সরকারের পক্ষ থেকে একটি ড্রাফ কমিটি করা দরকার জানিয়ে সাকি বলেন, ড্রাফ কমিটি শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের মতামতকে যুক্ত করে প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে দলিলটি তৈরি করতে হবে।

বৈঠকে ১২ দলীয় জোটসহ কয়েকটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। সিপিবি অংশই নেয়নি। বৈঠকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্যে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে নানা অসংগতি আর বৈঠক আয়োজনে সরকারের তরফ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অসামঞ্জস্য আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। সেখানে নেতারা বলেন, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সঠিকভাবে আচরণ করছে না। বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো থেকে শুরু করে খসড়া ঘোষণাপত্র বিলি-বণ্টনেও সঠিক পন্থা নেওয়া হয়নি। কোনো কোনো দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, কোনো দলকে বুধবার গভীর রাতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আবার খসড়া ঘোষণাপত্রও সব দলকে ঠিকমতো পৌঁছানো হয়নি বলে জানান তাঁরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি দল বৈঠকে জানায়, সময়মতো এবং অফিশিয়ালি তারা ঘোষণাপত্র না পাওয়ায় এটা নিয়ে তারা কোনো প্রস্তুতি নিতে পারেনি।