মায়ের হাতের রান্না
১০০ জন নারীর নিজ নিজ সন্তানকে জিজ্ঞেস করুন, কমপক্ষে ৯৭ জন বলবে পৃথিবীর মধ্যে তাদের মায়ের রান্নাই সেরা।
প্রথম নিউজ ডেস্ক: গড়পড়তা মেয়েদের হাতের রান্না তেমন আহামরি কিছু না, আমি নিজেও অনেক মেয়ের চাইতে কিছু আইটেম ভালো রান্না করতে পারি। আপনি আপনার আশেপাশের সার্কেলের ১০০ জন নারীর হাতের রান্না খান, দেখবেন এর মধ্যে হয়তো বড়জোর ১০ জনের রান্না আপনি দ্বিতীয়বার খেতে চাইবেন। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো আপনি এই ১০০ জন নারীর নিজ নিজ সন্তানকে জিজ্ঞেস করুন, কমপক্ষে ৯৭ জন বলবে পৃথিবীর মধ্যে তাদের মায়ের রান্নাই সেরা। কিন্তু কেন? আমার মনে হয় এর গভীর দার্শনিক ব্যাখ্যা আছে।
একজন মানুষ যখন একেবারেই শিশু; ভূমিষ্ট হওয়ার প্রথম কয়েকদিন শুধু মায়ের বুকের দুধ খায়, এই সময়ে তার মস্তিষ্ক ধারণ করতে থাকে কেবল তার মায়ের বুক এবং সেখান থেকে উৎসরিত অলৌকিক প্রস্রবণ, ভালো করে মাকে চেনার আগেই সে চেনে তার মায়ের বুক এবং তা হচ্ছে তার খাবারের একমাত্র উৎস। তার মা-ও যে খাবারের মালিক হয়েছে একমাত্র তার কারণেই।
একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে কিছু অনূভুতির সঙ্গে পরিচিত হয় কিন্তু সে বুঝতে পারে না কোন অনূভুতিটা কেন হচ্ছে। এই অক্ষমতা সে প্রকাশ করে কান্নার মাধ্যমে। মা-ই প্রথম এগুলোকে বুঝিয়ে দেন- কোনটা ক্ষুধার অনুভূতি, কোনটা ব্যথার, কোনটা ঘুম পাওয়ার, কোনটা প্রস্রাব পাওয়ার!
মা শিশুকে প্রথমে চেনায় ক্ষুধা- তার আগে সে জানতো না ক্ষুধা কী? তারপর চেনায় খাদ্য। যার আগে সে জানতো না খাদ্য কী? তারপর শিশু তার মস্তিষ্কে ধারণ করতে থাকে ক্ষুধা পেলে খাদ্য আর ব্যথা পেলে কান্না। সে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করে তার মা-ই তাকে চাঁদ তারা ডেকে, পাখিকে ডেকে বলতে থাকে অনেকটা এরকম - ‘আয় পাখি আমার সোনাবাবুর খাবারটা খা’, তারপর আবার ‘যা পাখি যা, আমার সোনাবাবুর খাবার তুই কেন খাবি’, ‘এইতো আমার বাবুটা খাচ্ছে’ ইত্যাদি। শিশু দেখে যে সে খাওয়াতে তার মা কতো খুশি। তার নিজের পেট ভরার আগেই তার মায়ের তৃপ্তি পাওয়ায় সে আনন্দিত হয়। এই অনূভুতিগুলোর সবই কিন্তু নতুন আর রোমাঞ্চকর।
আর একটু বড় হলে পর, সে ঝাল কতটুকু খায়? দুধ ছেড়ে এখন একটু একটু নুডলস খেতে পারে কি না? ডিম পোচ খাবে কি না? পেটে হজম হলো কি না? এলার্জি হচ্ছে কোনটাতে? এককথায় সন্তানের পুরো মেটাবলিক সিস্টেম বুঝতে চেষ্টা করেন মা, খাবার তৈরি করেন মা, খাবার নির্বাচন করেন মা, কোন খাবারটি তার বেশি পছন্দ তা সারাজীবন মনে রাখেন মা।
এরপর আসি সতর্কতার বিষয়ে। একবার দোকান থেকে আনা খোলা চিনির ভেতর চুনের টুকরা পাওয়া গেলো, আমার সন্তানের মা এরপর থেকে ছেলেমেয়েকে আর খোলা চিনি খাওয়ায় না, প্যাকেটের চিনি কিনতে হয়। বাজার থেকে আনা আতপ চাল অসংখ্যবার অব্যবহৃত রয়ে গেছে গন্ধ পাওয়ার কারণে, ঢাকনা না দেওয়া থাকায় বিড়াল মুখ দিলো কি না এই সন্দেহে ফেলে দেওয়া হয়েছে পাতিলসুদ্ধ দুধ।
মাছের কাঁটা বেছে দেওয়া, শাক-সবজি ডিমভাজি থেকে মরিচ ফেলে দেওয়া। শিশু একবারে কতটুু খেতে পারবে সেই অনুযায়ী লোকমা বানানো, ভাতের সঙ্গে কতটুকু সবজি বা কতটুকু মাংস দিলে সেটি সঠিক হবে তার সন্তানের জন্য? ঠিক কীভাবে খাওয়ালে তার সন্তান খুশি তা সন্তানের মুখের রেখা, চোখের পাপড়ির ওঠানামার গতি, গলদেশের সংকোচন-প্রসারণ পর্যবেক্ষণ করে করে দিনে রাতে, গ্রীষ্ম বর্ষায়, শীত গরমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আত্মস্থ করেন মা।
আর একটু বড় হলে স্কুলে যাওয়ার সময়, টিফিনের সময় কী খাবে তার সন্তান সেটা গুছিয়ে দেওয়া, সন্তানের কখন ক্ষুধা লাগলে তা ঠিক সময়মতো টের পাওয়া, সন্তান যখন যেটা চায় সেটা রান্না করে দেওয়া এমনকি একবেলা একটু কম খেলে পরের বেলার জন্য অস্থির হয়ে যাওয়া; খাওয়ার সময় পাশে বসে থাকা- এটা ওটা এগিয়ে দেওয়া, সেধে সেধে খাওয়ানো, সমস্তটাই করেন একমাত্র মা।
সন্তান বড়ো হলে দূরে থাকলে তার জন্য পছন্দমতো খাবারের ব্যবস্থা করা, ফোন করে খবর নেওয়া, খাবার ভালো না হলে কষ্ট পাওয়া, বাড়ি আসলে ‘স্বাস্থ্য কমে গেছে’ বলে কাঁদতে শুরু করা, সবটাই যেন মায়ের কাজ! দূর পাল্লার যাত্রায় ভোর তিনটায় উঠে পছন্দের তরকারি, গরম ভাত রান্না করে সন্তানকে খাইয়ে দাইয়ে বিদায়ও দেন মা।
তো, মায়ের রান্না মজা হবে না তো কার রান্না মজা হবে? লাখো কোটি শুকরিয়া, আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ, আমার মা-বাবাকে এখনও প্রাণভরে ডাকতে পারি, মন চাইলেই কথা বলতে পারি। আল্লাহ পাক আমার মা-বাবা সহ সব মা-বাবাকে নেক হায়াত ও সুস্থতা দান করুন।