মোটরসাইকেল কেনার টাকা যোগাতে নিবিড়কে হত্যা করেন সিয়াম
অপহরণ করার পর নিবিড় চিৎকার করলে তাকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়।
প্রথম নিউজ, শরীয়তপুর: শরীয়তপুরের শিশুকানন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী হৃদয় খান নিবিড় (১১) হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন তিন আসামি। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তারা বলেছেন, মোটরসাইকেল কেনার টাকা জোগাতে হৃদয়কে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবির পরিকল্পনা করেন সিয়াম ও তার সহযোগীরা। অপহরণ করার পর নিবিড় চিৎকার করলে তাকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়।
গত বুধবার (২ আগস্ট) শরীয়তপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল হৃদয় খান নিবিড় হত্যার অভিযুক্ত শাওন চৌকিদার (২০), শাকিল গাজীকে (১৮) পাঁচদিন ও বয়স কম হওয়ায় এ ঘটনায় অভিযুক্ত এক কিশোরকে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ায় সিয়ামকে (২০) রিমান্ডে নেওয়া হয়নি।
রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সিয়াম (২০), শাকিল গাজী (১৮) ও ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর। এ ঘটনার আরেক আসামি শাওন চৌকিদার (২০) এখনো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। আসামিদের মধ্যে তিনজনকে শরীয়তপুর জেলা কারাগারে এবং ওই কিশোরকে গাজীপুরের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।
শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের খিলগাঁও এলাকার প্রবাসী মনির হোসেন খানের ছেলে হৃদয় খান নিবিড়কে গত সোমবার (৩১ জুলাই) অপহরণ করে হত্যার পর মাটিচাপা দেওয়া হয়। তারপর তার মায়ের মুঠোফোনে কল করে মুক্তিপণ দাবি করেন অপহরণকারীরা। মুক্তিপণ চাওয়ার ঘটনা পুলিশকে জানালে পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে চারজনকে আটক করে। আটককৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার (১ আগস্ট) ভোরে খিলগাঁও এলাকার মেসার্স খান ব্রিকসের পাশের একটি নির্জন স্থান থেকে ওই শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
হৃদয় খান নিবিড় হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পালং মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক শরীফুল ইসলাম বলেন, হৃদয় খান নিবিড় হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারের পর রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। সিয়ামকে রিমান্ডে নেওয়ার আগেই বৃহস্পতিবার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেজবা উদ্দিন খানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। এরপর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর রোববার শাকিল গাজি ও ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রুমানা আক্তারের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দির বরাত দিয়ে শরীফুল ইসলাম বলেন, নিবিড়দের বাড়িতে আট বছর ধরে ভাড়া থাকতেন সিয়াম। এই সুযোগে সিয়ামের সঙ্গে নিবিড়দের সখ্যতা গড়ে ওঠে। সিয়াম বালু-মাটি পরিবহনের একটি ড্রাম ট্রাক ড্রাইভার ছিলেন। নিবিড় ওই ট্রাকে উঠে ঘুরতে পছন্দ করত। নিবিড়কে নিয়ে সিয়াম, তার সহযোগী শাকিল গাজী এবং ওই কিশোর প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যেতেন।
জবানবন্দিতে আসামিরা বলেছেন, সিয়াম একটি মোটরসাইকেল কেনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার কাছে মোটরসাইকেল কেনার টাকা ছিল না। বিষয়টি নিয়ে সিয়াম তার সহযোগীদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা পরিকল্পনা করেন, নিবিড়কে আটকে রেখে জিম্মি করে তার পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত সোমবার (৩১ জুলাই) বিকেলে নিবিড়কে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ট্রাকে উঠিয়ে নেন সিয়াম। একপর্যায়ে তাকে কীর্তিনাশা নদীর তীরে নিয়ে যান। এরপর সহযোগী শাকিল এবং ওই কিশোরকে ডেকে আনেন সিয়াম। শাকিল ও এই কিশোর আসার পর ট্রাকটি নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিবিড়কে আটক করার চেষ্টা করলে সে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। তখন তারা নিবিড়ের মুখে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করেন।
এরপর ট্রাক থেকে লাশটি নামিয়ে পাশের নির্জন স্থানে ইটভাটা সংলগ্ন কীর্তিনাশা নদীর পাড়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়। নিবিড়কে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া শেষে সন্ধ্যা ৭টার দিকে নিবিড়ের মা নিপা আক্তারের মুঠোফোনে ফোন করে ছেলেকে অপহরণ করা হয়েছে জানিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়।
নিবিড়ের মা নিপা আক্তার বলেন, আমাদের বসতবাড়ির একটি ঘরে সিয়ামের পরিবার ভাড়া থাকত। তাদের বাড়ি পাবনার সিংগা এলাকায়। ভাড়াটিয়া হিসেবে সিয়ামের সঙ্গে নিবিড় মিশত। তার সঙ্গে কোথাও গেল সন্দেহের চোখে দেখত না কেউ। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে এমন কাজ করবে, তা কখনো চিন্তায় আসেনি। আমার ছেলে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
পালং মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন বলেন, তিনজন আসামি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তারা বিচারকের কাছে নিবিড়কে হত্যার বিবরণ ও পরিকল্পনার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। আরেক আসামি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি। তার বিষয়ে তদন্ত চলছে। প্রয়োজনে পুনরায় তার রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করা হবে। এদিকে হৃদয় খান নিবিড় হত্যায় জড়িতদের ফাঁসির দাবিতে স্বজন ও এলাকাবাসী মঙ্গলবার (০৮ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও শহরের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এই বিক্ষোভে প্রায় দুই হাজারের বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেন।