‘বাংলাদেশের কোনো ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না বেইজিং’

গতকাল ‘বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক: ভবিষ্যতের পূর্বাভাস’- শীর্ষক কসমস ডায়ালগে ইয়াও ওয়েন বলেন, চীন বাংলাদেশের নিজস্ব  উন্নয়নের পথ বেছে নেয়ার বিষয়টিকে সম্মান করে এবং এর ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ ও পারস্পরিক শিক্ষা জোরদার করতে ইচ্ছুক।

‘বাংলাদেশের  কোনো ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না বেইজিং’

প্রথম নিউজ, অনলাইন: বাংলাদেশের রাজনীতি বা কোনো ইস্যুতেই তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না বেইজিং- কূটনৈতিক ভাষায় সেটা ফের স্মরণ করিয়ে দিলেন ঢাকাস্থ চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। গতকাল ‘বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক: ভবিষ্যতের পূর্বাভাস’- শীর্ষক কসমস ডায়ালগে ইয়াও ওয়েন বলেন, চীন বাংলাদেশের নিজস্ব  উন্নয়নের পথ বেছে নেয়ার বিষয়টিকে সম্মান করে এবং এর ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ ও পারস্পরিক শিক্ষা জোরদার করতে ইচ্ছুক। চীন ও বাংলাদেশের উচিত মূল স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে একে- অপরের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা এবং এক কণ্ঠে বাহ্যিক হস্তক্ষেপকে ‘না’ বলা। সিম্পোজিয়ামে প্রদত্ত মূল বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের মধ্যস্থতাসহ সম-সাময়িক বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেন।

গত মার্চে বিদেশি হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান বিষয়ক বাংলাদেশের অবস্থানের প্রতি বেইজিংয়ের দৃঢ় সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। তখন তিনি বলেছিলেন- বাংলাদেশের প্রতি চীন ধারাবাহিক নীতি বজায় রেখেছে। চীন সব সময় বাংলাদেশের বিশ্বস্ত কৌশলগত অংশীদার। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে চীন। জানুয়ারিতে ঢাকায় দায়িত্ব নেয়া ইয়াও ওয়েন গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠকের পরও বলেছিলেন অন্য দেশগুলোর মতো চীন বাংলাদেশ বা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। কারও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চীন নাক গলায় না। তবে হ্যাঁ, চীন অবশ্যই বাংলাদেশের উন্নয়ন চায়। এ দেশের মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে পাশে থাকতে চায়। 

রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে চাই, যেকোনো যৌক্তিক প্রয়োজনে চীন বরাবরের মতো বাংলাদেশের পাশে থাকবে। কসমস ফাউন্ডেশন আয়োজিত সিম্পোজিয়ামে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতি আঙ্গুল তুলে বলেন, বিশ্ব আজ অদৃশ্য বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং সমৃদ্ধির পেন্ডুলাম প্রাচ্যের দিকে ঝুঁকছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীন ও বাংলাদেশ উভয়ই নজিরবিহীন সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। উন্নয়ন ও সীমান্ত প্রতিরক্ষা নিয়ে দুই দেশ কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, যেকোনো মূল্যে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চীন কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে বিশ্বাসী চীন। বিদেশি হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে এমন আশা করে চীনা দূত আরও বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে এক নম্বর অর্থনীতির দেশ হবে চীন।

বিশ্বের অগ্রগতির জন্য মার্কিন-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার হওয়া প্রয়োজন হলেও তা ক্রমশ নিম্নগামী। এ সময় ভারত ও চীনের সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেন রাষ্ট্রদূত। তার ভাষ্য ছিল- চীন ও ভারত একসঙ্গে কোনো বিষয়ে কথা বললে গোটা বিশ্ব তা গুরুত্বসহকারে শুনবে। দু’দেশ একজন আরেকজনের নিরাপত্তার হুমকি হবে না। ভারতের এ বিষয়ে ভাবা উচিত। বিদ্যমান বাস্তবতায় বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করা উচিত উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য আমাদের নতুন প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রগুলো অন্বেষণ করা জরুরি।

 গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই), গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ (জিএসআই) এবং গ্লোবাল সিভিলাইজেশন ইনিশিয়েটিভের (জিসিআই) আওতায় সহযোগিতার সুযোগ অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চীন ইচ্ছুক জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে শিল্পের উন্নয়ন ও ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে এবং ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর গুণগত মান ও প্রতিযোগিতার মান উন্নয়নে বেইজিং ইচ্ছুক। রাষ্ট্রদূত ইয়াও সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশের স্বতন্ত্র ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক দেখেছেন জানিয়ে বলেন, আইপিও’র অনেক কিছু চীনের ধারণার অনুরূপ। স্বাধীনতার পররাষ্ট্রনীতি সংরক্ষণের পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে চীন সমর্থন করে জানিয়ে তিনি বলেন, এ বছর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) চালুর দশম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে।

বিআরআই’র আওতায় পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের মতো বাংলাদেশে মোট আটটি মেগা প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করে ব্যবহার উপযোগী করা হবে। রাষ্ট্রদূত ২০১৬ ও ২০১৯ সালে উচ্চ পর্যায়ের সফরের ফলাফল এবং বিআরআই’র আওতায় সহযোগিতা জোরদারের কথা তুলে ধরে বলেন, দ্রুত রাজশাহী সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্রকল্পের কাজও শুরু হবে। সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রাষ্ট্রদূত ইয়াও বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের উচিত নিজ নিজ জাতীয় অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নের পথ অনুসরণে একে-অপরকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন অব্যাহত রাখা। কারণ চীন ও বাংলাদেশ উভয়ের আধুনিকীকরণের সঙ্গে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী জড়িত। 

রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ওই সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন- কসমস ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও সাবেক পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন- কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এনায়েতুল্লাহ খান। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আলোচক হিসেবে ছিলেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসি রিসার্চের ভাইস ডিন প্রফেসর কান্তি বাজপেই, চীনের সেন্টার সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (এসআইআইএস) এর সিনিয়র ফেলো এবং চীন ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মহাসচিব লিউ জংয়ি, চীনের ফুদান ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক লিন মিনওয়াং, চীনের সেন্টার সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (এসআইআইএস) এর ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সহকারী রিসার্চ ফেলো এল আই হংমেই এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম প্রমুখ।

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আন্তরিকভাবে মধ্যস্থতা করছে চীন: এদিকে সিম্পোজিয়ামে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় সমাধানের একমাত্র উপায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। যদিও এটা চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়। তারপরও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বেইজিং এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন কার্যকর ভূমিকা রেখে আসছে। রাষ্ট্রদূত বলেন, অনেক রাষ্ট্র মুখে বড় প্রতিশ্রুতি দিলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মধ্যস্থতায় একমাত্র চীনই কার্যকর ভূমিকা রাখছে। চীন একটি দায়িত্বশীল বন্ধু হিসেবে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন তরান্বিত করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অবিচলভাবে মধ্যস্থতা করছে।